মহাবিশ্বের সৃষ্টির সময়ের রথে যাত্রা হল শুরু
আজকের এই আলোচনায় আমরা জানবো মহাবিশ্বের সৃষ্টির সময়ের রথে যাত্রা হল শুরু নিয়ে। আমাদের সাথেই থাকুন এবং জেনে নিন এই বিষয়ে বিস্তারিত। মার্কিন বিজ্ঞানী গ্যামো বলেছেন, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ব্যাসার্ধ হচ্ছে ২ x ১০২৩ মাইল । হিসেবটা আনুমানিক অবশ্যই। এই মহাবিশ্বে তারাজগত বা গ্যালাক্সির মোট সংখ্যা কত, তা জানার কোন উপায়ই নেই । আলোক দূরবীনের সাহায্যে এ পর্যন্ত হাজার কোটি গ্যালাক্সির সন্ধান পাওয়া গেছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, সবচেয়ে জোরালো আলোক দূরবীনের নাগালের মধ্যে ১ ট্রিলিয়ন বা এক লক্ষ কোটি গ্যালাক্সি থাকার সম্ভাবনা। এবং এখানেই শেষ নয় । বর্তমানে আমরা টেলিস্কোপের সাহায্যে ১০ বিলিয়ন আলোকবর্ষ পর্যন্ত দেখতে পারি।
মহাবিশ্বের সৃষ্টির সময়ের রথে
এমন সব তারাজগৎ ও আবিষ্কার হচ্ছে সেখান থেকে আলো পৃথিবীতে পৌঁছতে লেগে গেছে ১৫ বিলিয়ন আলোকবর্ষ। সুতরাং বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের বঘস অবশ্যই ১৫ বিলিয়ন বৎসরের বেশি বৈ কম নয়। বিশ্বজগতের সৃষ্টির সাথে সাথেই অবশ্য সময়েরও সৃষ্টি হয়েছিল এবং সে তার যাত্রাপথ শুরু করেছিল সেই ঊষালগ্নে।
এই বিশাল মহাবিশ্বের জীবন নাট্যের শুরু করে কোথায়, কিভাবে এবং শেষ পরিণতি তার কি—এ সম্বন্ধে আমাদের কৌতূহলের অন্ত নেই। মহাবিশ্বের সৃষ্টির ব্যাপারে দুটি তত্ত্ব রয়েছে বর্তমানে। একটি হলো স্থিতাবস্থাশীল তত্ত্ব (Theory of the evolving universe), অপরটি হলো স্থিতাবস্থাশীল তত্ত্ব (Steady state theory of the universe);
এই মহাবিশ্ব যে প্রসারিত হয়ে চলেছে তাতে সন্দেহ নেই। প্রশ্নটা হল, এই প্রসারণের ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল কবে? সময়ের রথে চড়ে আমরা যত পেছনের দিকে যাব দেখব তারাজগতেরা আজকের তুলনায় পরস্পরের অনেক কাছাকাছি ছিল। এভাবে পেছোতে পেছাতে আমরা সত্যিই এমন একটা সময়ে পৌঁছে যাই যখন গ্যালাক্সিগুলো একে অপরের ঘাড়ের উপর চড়েছিল । সেটা কবে?
বিজ্ঞানীদের হিসেব অনুযায়ী আনুমানিক দু’হাজার কোটি বা ২০ বিলিয়ন বছর আগে মহাবিশ্বের সমস্ত বস্তু ও শক্তি এক অতি ক্ষুদ্র আয়তনের (Zero volume) মধ্যে জড়ো হয়েছিল। গোটা মহাবিশ্বটাই ছিল যেন একটি একক বিন্দু বা Singularity যা ইতিপূর্বেই আলোচিত হয়েছে।
- আরও পড়ুনঃ বাংলা সনের জন্মকথা
মহাবিশ্বের সৃষ্টির সময়ের বিবর্তন তত্ত্ব
দু’হাজার কোটি বছর আগে মহাবিশ্বের সব বস্তু ও শক্তি এক মহাডিম্বের (Cosmic egg) ভিতর ভরা ছিল। কিন্তু এরা এলো কোত্থেকে, কে এদের সৃষ্টি করল কেন ও কিভাবে এবং সবাই এক জায়গাতেই বা জড়ো হলো কেন, এসব প্রশ্নের কোন সঠিক জবাব আমাদের জানা নেই।
মহাডিম্বের ভিতরে সব পদার্থ ছিল শক্তি বা বিকীরণের আকারে। ঘন সন্নিবদ্ধ অবস্থায় ঐ বিকীরণপুঞ্জের ভেতরের তাপ দাঁড়িয়েছিল বহু লক্ষ কোটি ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে।
শক্তির ঐ গোলকটির ব্যাস ছিল ২৭০ কোটি কিলোমিটার। এক বিপুল চাপের মধ্যে থাকার ফলে ঐ শক্তিপুঞ্জের ঘনত্ব ছিল এত বেশি যে, ওর প্রতি ঘন ইঞ্চি পরিমাণ ক্ষেত্রে শক্তির ওজন দাঁড়িয়েছিল দশ কোটি টন। (মহাবিশ্বের সৃষ্টির সময়ের রথে যাত্রা হল শুরু)
শক্তিরূপী ঐ মহাডিম্ব কতদিন ধরে একই অবস্থায় ছিল তা কারুর জানা নেই । হঠাৎ একদিন ওর মধ্যে বিরাট এক বিস্ফোরণ ঘটল। সঙ্গে সঙ্গে ঐ বিপুল শক্তি ওদের বন্দীদশা থেকে ছাড়া পেয়ে চারদিকে ছুটল।
ঐ বিস্ফোরণ থেকেই নাকি সৃষ্টি হয়েছিল মহাবিশ্বের । একেই বলা হয় বিগ ব্যাংগ (Big Bang) বা বিরাট বিস্ফোরণ বা মহাধ্বস।
এ তত্ত্বের প্রবক্তা হলেন বেলজিয়ামের লেমেইতার ও আমেরিকার বিজ্ঞানী গ্যামো (রুশ অভিবাসী)। বিস্ফোরণের সময় মহাকর্ষ বল, বিদ্যুৎ চুম্বক বল, প্রবল কেন্দ্রকণীয় বল ও দুর্বল কেন্দ্রকণীয় বল, প্রকৃতির এই চারটি মৌলিক বল একত্রীভূত ছিল। বিরাট বিস্ফোরণের ১০-৪৩ সেকেন্ড পরে মহাকর্ষ বল অন্য তিনটি বল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এ সময় মহাডিম্বের তাপমাত্রা ছিল ১০৩২ কেলভিন, ভর ছিল ১০৪৬ টনের কয়েক গুণ ৷
- আরও পড়ুনঃ সময় মাপার নীতিসমূহ
বিগ ব্যাং হওয়ার সময়
(মহাবিশ্বের সৃষ্টির সময়ের রথে যাত্রা হল শুরু) বিস্ফোরণের ১০-৬ সেকেন্ড সময়ে বিশ্ব প্রায় সৌরজগতের আকার ধারণ করে, তাপমাত্রা হয় ১০১৩K. এই নিম্ন তাপে কোয়ার্ক যুক্ত হয়ে প্রোটন ও নিউট্রন সৃষ্টি করে। পদার্থ ও প্রতি-পদার্থ পরস্পরকে ধ্বংস করে। সৌভাগ্যক্রমে পদার্থের পরিমাণ সামান্য বেশি ছিল। সেই অতিরিক্ত পদার্থ থেকেই বর্তমান বিশ্বের সমস্ত পদার্থের উদ্ভব হয়েছে।
তিন মিনিটের সময়ে বিশ্বের তাপমাত্রা ছিল ১০৯K অর্থাৎ একশ কোটি ডিগ্রী কেলভিন। প্রোটন ও নিউট্রন একত্রিত হয়ে পরমাণুর কেন্দ্রকণা গঠন করে। এভাবে ১ লক্ষ বৎসর কেটে যায়। তারপরে কেন্দ্রকণার সঙ্গে ইলেকট্রন যুক্ত হয়ে পরমাণু গঠন করে। পদার্থ থেকে বিকিরণ পৃথক হয়ে যায়, আলো মহাশূন্যে চলতে আরম্ভ করে।
তাপ কমে আসার ফলে বিভিন্ন পদার্থের পরমাণুদের গড়ে ওঠা সম্ভবপর হল । প্রথমে হাইড্রোজেনের জন্ম হল। তারপর হিলিয়াম, লিথিয়াম ও অন্যান্য হাল্কা জাতের মৌলিক পদার্থের পরমাণুরা।
গড়পড়তা তাপমাত্রা যখন আরো নেমে এল, ভারী মৌলিক পদার্থের পরমাণুরা তখনই সৃষ্টি লাভ করল। বিস্ফোরণের আধঘন্টার মধ্যেই হাল্কা ও ভারী সব ধরণের মৌলিক পদার্থের পরমাণুরা গড়ে উঠেছিল, তবে ওরা সবাই ছিল গ্যাসীয়রূপে;
মহাডিম্বের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটার পর দীর্ঘ তিনকোটি বছর ধরে বিভিন্ন গ্যাসীয় পদার্থের ছুটে চলার মধ্য দিয়ে মহাবিশ্বের আয়তনও প্রসারিত হয়ে চলল। মহাডিম্বের আভ্যন্তরীণ সঞ্চিত তাপের মাত্রা যখন নেমে এল গড়পড়তা আশি ডিগ্রি ফারেনহাইটে,
তখন ভারী মৌলিক পদার্থের পরমাণুরা—যারা ছিল গ্যাসীয়রূপে, ওরা এক জায়গায় জড়ো হয়ে কঠিন বস্তুর ধূলো-কণাদের গড়ে চলল ।
বিশাল আকারের ধূলো আর গ্যাসের মেঘে ধীরে ধীরে ভরে উঠল মহাবিশ্ব
চারদিকে ছিল শুধু সীমাহীন অন্ধকার আর পরম শীতলতা। আলো ছিল না কোথাও— নক্ষত্রদের সৃষ্টি হয়নি তখনো। সেই অন্ধকারের মধ্যদিয়ে ধূলো আর গ্যাসের বিরাট মেঘগুলো শুধু অবিশ্রান্তভাবে বাইরের দিকে চলেছিল ছুটে !
এরপর পঁচিশ কোটি বছর ধরে আর একটি ঘটনা ঘটতে লাগল। গ্যাসের মেঘগুলোর মধ্যে একদিন শুরু হল নিজেদের অক্ষের চারপাশে চরকিবাজির মত ঘুরপাক খাওয়ার কাজ । আর তারই ফাঁকে চারপাশে ছড়ানো ধূলোর মেঘগুলোকে যেন শুষে নিয়ে ওরা নিজেদের আয়তন বাড়িয়ে চলল ।
যে বিশাল চেহারার ধূলো আর গ্যাসের মেঘগুলো এভাবে গড়ে উঠল, ওরা আবার ভেঙ্গে গিয়ে চক্রাকারে ঘুরতে থাকা ছোট ছোট বহু আবর্তের সৃষ্টি করে বসল। ঐ মেঘগুলোর এক একটির দৈর্ঘ্য ছিল কয়েক হাজার থেকে কয়েক লক্ষ আলোকবর্ষ; (মহাবিশ্বের সৃষ্টির সময়ের রথে যাত্রা হল শুরু)
ঘনত্ব ও চাপ বাড়তে বাড়তে একদিন ঐ সব ধূলো ও গ্যাসের চক্রের কেন্দ্রে তাপের পরিমাণ যখন দু’কোটি ডিগ্রি ফারেনহাইট এসে পৌঁছল, তখন হঠাৎ জ্বলে উঠল তাপ- পারমাণবিক চুল্লীটা ওরা পরিণত হল নক্ষত্রে।
অসংখ্য নক্ষত্রের সৃষ্টি যেমন এভাবে ঘটতে লাগল, তেমনি তৈরি হতে থাকা বহু নক্ষত্রেকে নিয়ে ধূলো ও গ্যাসের এক একটি বিরাট মেঘ আলাদা আলাদা গ্যালাক্সিরূপে গড়ে উঠল ।
জন্মলগ্ন থেকে তারাজগতগুলোর ঐ যে বাইরের দিকে ছুটে চলা, তা আজও চলছে অবিচ্ছিন্নভাবে। চলছে নক্ষত্রের জীবনের সৃষ্টি চক্র।
ক্রমাগত প্রসারিত হতে হতে সমগ্র মহাবিশ্বই একদিন এমন এক অবস্থায় এসে পৌঁছবে, যেদিন বস্তুর ঘনত্ব নেমে আসবে এক নিম্নতম অঙ্কে এবং বস্তুহীন মহাবিশ্ব সমগ্র শক্তি ছড়িয়ে দিয়ে এক পরম শীতলতায় আচ্ছন্ন হয়ে যেন এক মহাকালের কোলে ঢলে পড়বে।
মহাবিশ্বের অপরিবর্তনশীলতা
ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানী হয়েল, গোল্ড ও বন্ডি এই দ্বিতীয় তত্ত্বের প্রবক্তা। তারা বললেন, এই মহাবিশ্বের কোন আদি নেই, কেন্দ্র নেই, অন্ত নেই–এ যেন এক অবিচ্ছিন্ন প্রবাহ। এ অতীতেও যেমন ছিল। বর্তমানেও তেমনি রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও তাই থাকবে। মহাবিশ্বে সময় ও ক্ষেত্র দুইই অনন্ত ।
প্রসারণের ফলে মহাবিশ্বের তারাজগতেরা একদিন অনন্ত ক্ষেত্রের মধ্যে হারিয়ে যাবে ঠিকই।
জড়ের ঘনত্ব তাতে কমে চললেও জড় কিন্তু অবিরামভাবে সৃষ্টি হচ্ছে।
মৌলিক উপাদান হাইড্রোজেনের পরমাণু প্রতিনিয়ত মহাকাশ জুড়ে তৈরি হয়ে চলেছে অসংখ্য পরিমাণে।
ওদের সমবায়ে আবার গড়ে উঠে নতুন তারাজগত।
বিশ্ব সম্প্রসারণের ফলে ছায়াপথসমূহ দূরে অপসারিত হওয়ায় যে স্থান শূন্য হচ্ছে, সেখানে এই নব সৃষ্ট হাইড্রোজেন পরমাণু দ্বারা নতুন ছায়াপথের সৃষ্টি হচ্ছে। (মহাবিশ্বের সৃষ্টির সময়ের রথে যাত্রা হল শুরু) ফলে জড়ের ঘনত্ব সর্বত্র সমানই থাকবে। মহাবিশ্বের চেহারার মধ্যেও মোটামুটি কোন পরিবর্তন ঘটবে না;
এই স্থিতাবস্থা বা অবিরাম সৃষ্টি তত্ত্বে কোন ‘মহাজাগতিক, অতি ক্ষুদ্র, অতি ঘন, অতি উত্তপ্ত অগ্নিগোলক ছিল না’। এই তত্ত্ব পদার্থবিদ্যার অন্যতম মূল সূত্র ‘ভর-শক্তির নিত্যতারূপ’ বা Conservation law of mass energy কে খণ্ডন করে বসল।
জড়বস্তুর ভর শক্তিতে রূপান্তরিত হতে পারে, আবার শক্তি রূপান্তরিত হতে পারে ভরে, কিন্তু nothingness বা কিছু না থেকে কিভাবে জড় তৈরি হতে পারে এ প্রশ্নের জবাব এই তত্ত্বের কাছ থেকে পাওয়া যায় নি । মহাবিশ্বে জড় কিভাবে, কি পরিমাণে তৈরি হচ্ছে সে সম্বন্ধেও পরিস্কার নয়। এতে অবিরাম সৃষ্টি তত্ত্ব সঠিক নয় বলেই মনে হয়।
পৌনঃপুনিক বিশ্ব সৃষ্টি তত্ত্ব
বিশ্ব সৃষ্টি সম্বন্ধে আরো একটি তত্ত্ব প্রচলিত আছে। একে দোলায়মান বা পৌনঃপুনিক (oscillating) বিশ্বতত্ত্ব বলে। স্থিতাবস্থা তত্ত্বের মত এ তত্ত্বেও বলা হয় যে, বিশ্বের কোন আদি নেই, কোন অন্তও নেই। তবে বিশ্ব চিরকাল একই অবস্থায় থাকে না।
বর্তমানে বিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে, এই সম্প্রসারণ শুরু হয় একটা বিরাট বিস্ফোরণের সঙ্গে। এই সম্প্রসারণ ক্রমশঃ স্তিমিত হয়ে আসবে। এমন এক সময় আসবে যখন মহাকর্ষ বল সম্প্রসারণ বলের ওপরে প্রাধান্য বিস্তার করবে, বিশ্ব সঙ্কুচিত হতে থাকবে এবং এক সময় ধসে পড়বে ।
এভাবে আবার সেই অতিক্ষুদ্র, অতি ঘন, অতি উত্তপ্ত অগ্নিগোলকে পরিণত হবে, আবার বিরাট বিস্ফোরণ ঘটবে, আবার বিশ্বে বিবর্তন চলতে থাকবে। আবার একই ঘটনা শৃঙ্খলের পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকবে। বিশ্ব বিরাট বিস্ফোরণও বিরাট ধসের ভিতরে দোলায়মান থাকবে ।
১৯৬৪ সালে হয়েল ও ভারতীয় বিজ্ঞানী নারলিকার এই নতুন তত্ত্ব উপস্থিত করেন ! তারা বললেন, মহাবিশ্বের চেহারাটা সর্বত্র সমান নয়। এখানে তারাজগত ও তারাজগতের দল শৃঙ্খলাবদ্ধভাবেও ছড়িয়ে নেই।
এরকম একটি বিশ্বে আবার সর্বত্র জড় সৃষ্টির কাজ চলছে না, কতকগুলো বিচ্ছিন্ন পকেট বা ক্ষেত্রের মধ্যেই সেটা ঘটছে। গ্যালাক্সির চারপাশে জোরালো অভিকর্ষ বলযুক্ত ক্ষেত্রেই জড় পদার্থ সৃষ্টি হচ্ছে।
- আরও পড়ুনঃ বিশ্বকোষের ভাষায় সময় বা কাল
মহাবিশ্বের যে সব জায়গায় জড়ের সৃষ্টি হচ্ছে, ওদের চারপাশে গড়ে ওঠছে সৃষ্টিক্ষেত্র বা Creation field. কোয়াসারের মধ্যে জড়ের ঘনত্ব কিভাবে এক বিপুল অঙ্কে পৌঁছাচ্ছে এ প্রশ্নের জবাব এই নতুন তত্ত্ব দিতে পারেনি। (মহাবিশ্বের সৃষ্টির সময়ের রথে যাত্রা হল শুরু)
এরপর এ ধারণার পরিবর্তে একটি স্পন্দনশীল বিশ্বের ধারণাই প্রাধান্য পাচ্ছে বেশি। এ হল এমন একটি মহাবিশ্ব, যার বিস্তৃতি সীমাবদ্ধ।
এই মহাবিশ্ব ক্রমিকভাবে প্রসারিত ও সঙ্কুচিত হচ্ছে এবং এক একটি প্রসারণে ও সঙ্কোচনের কাল ফল ৮ কোটি বছর। এভাবে ৪২ বিলিয়ন বৎসর ধরে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড প্রসারিত হবে। তারপর আসবে সঙ্কোচনের পালা-সবশেষে বিগ ব্যাংগ-আবার সৃষ্টি আবার প্রসারণ;
মহাবিশ্বের সৃষ্টির সময়ের অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত
আমরা যখন মহাবিশ্বের অনন্ত ক্ষেত্রের মধ্যে দৃষ্টিকে প্রসারিত করি তখন আমরা সময়ের রথে চড়ে অতীতের দিকেই এগিয়ে চলি। তত্ত্ব ও পর্যবেক্ষণ উভয়েই নির্দেশ করে যে,
বর্তমান বিশ্ব যে পদার্থ দিয়ে গঠিত, এক হাজার কোটি বৎসর পূর্বেও বিশ্বে সেই পদার্থই অতি ঘন, অতি উত্তপ্ত অবস্থায় ছিল, বিশ্বের ব্যাস ছিল মাত্র ১০-২৮ সেন্টিমিটার, ভর ছিল ১০৪৬ টনের কয়েক গুণ। বর্তমান মতবাদ হচ্ছে, বিস্তৃতি আরম্ভের ১০ কোটি থেকে ১০০ কোটি বৎসরের ভিতরেই ছায়াপথসমূহের সৃষ্টি হয়ে গেছে।
বিরাট বিস্ফোরণের ১০ লাখ বৎসর পরে বিশ্বের তাপমাত্রা ছিল ৫০০০°K, বর্তমানে হচ্ছে ২.৭°K অর্থাৎ মাইনাস ২৭০°। এটা জানা বিশেষভাবে প্রয়োজন যে, এককত্ব (Singularity) বা শূন্য সময়ের নিকটবর্তী সময়ে, আমাদের জানা পদার্থ বিদ্যা কোন বিষয়ের কোন প্রকার ব্যাখ্যা দিতে সম্পূর্ণরূপে অপরাগ।
এই অবস্থায় আমরা এমন একটা জগতে প্রবেশ করি, যেখানে প্রাচীন ধারণা ও কোয়ান্টাম তত্ত্ব, বিশ্বের অবস্থার বর্ণনা দিতে অক্ষম।
আমাদের সাধারণ দৃশ্য বৃহৎ বস্তুর (macroscopic) জগতে, কোয়ান্টাম তত্ত্বের বিচ্ছিন্নতা থেকে উদ্ভূত সমস্যার মোকাবিলা না করেই, মহাকর্ষ ক্ষেত্র বিবেচনা করতে পারি । কিন্তু আমরা ক্রমে যতই ছোট মাত্রার পদার্থের বিষয় বিবেচনা করতে থাকি (microscopic), ততই এমন একটা অবস্থার কাছে আমরা পৌঁছাই, যে অবস্থা আর স্বীকার করে নেয়া যায় না।
যতই এককত্বের নিকটবর্তী হওয়া যায়
ততই মহাকর্ষ ক্ষেত্রের কোয়ান্টাম পরিবর্তন এত বেশি হয় যে পদার্থবিদ্যার বিধিসমূহ প্রয়োগ করা আর সম্ভবপর হয় না। একটি কল্পিত অসীম ঘনত্বের, অনন্ত ক্ষুদ্রায়তনের বিশ্বের বিস্তৃতিতে এই মাত্রায় পৌঁছায়, শূন্য সময়ের ১০-৪৩ সেকেন্ড সময় পরে, তখন ঘনত্ব হয় প্রতি ঘন সেন্টিমিটারে ৫ × ১০৯৩ গ্রাম।
বিশ্বের বয়স ১০-৪৩ তখন সেকেন্ড হয়ে গেছে। বিশ্বের তাপমাত্রা ছিল তখন ১০৩২K । এই সময়ে বিশ্ব ক্ষণস্থায়ী অদ্ভুত কণা, প্রতি কণা ও তীব্র বিকিরণ দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল । এই কণাসমূহ ফোটন সৃষ্টি করে। এই কণা ও ফোটনের পিণ্ড বিস্তৃত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত শীতল হতে থাকে। (মহাবিশ্বের সৃষ্টির সময়ের রথে যাত্রা হল শুরু)
১০০ সেকেন্ডে তাপমাত্রা ১০৯K এ হ্রাস পায়, ১০০ সেকেন্ড করে ১০ লাখ বছর ধরে বিশ্বের বিস্তৃতি চলতে থাকে এবং তাপমাত্রা ৫০০০°K ডিগ্রিতে নেমে যায় । এই সময়ে আয়নিত গ্যাস গঠন হয় । তারও পরে তাপমাত্রা আরও কয়েক হাজার ডিগ্রি কমে গেলে নিউট্রাল হাইড্রোজেন গঠন হয়-সাথে সাথে পদার্থ ও বিকিরণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
- আরও পড়ুনঃ সাধারণ ভগ্নাংশ এবং ভগ্নাংশের তুলনা
মহাবিশ্বের বর্তমান ও ভবিষ্যত
বর্তমানে দুটি ধারণা প্রচলিত আছে । তা হল :
(১) বিশ্ব হয়, অনন্তকাল ধরে সম্প্রসারিত হতে থাকবে। সম্প্রসারণের বেগ কমতে থাকবে, কিন্তু বিশ্ব উন্মুক্ত থাকবে। আর না হয়,
(২) সম্প্রসারণ বন্ধ হয়ে যাবে, এবং বিশ্ব নিজের উপরে ধ্বসে পড়ে অতি ঘনত্ব প্রাপ্ত হবে বা বিশ্ব বন্ধ হয়ে যাবে। এই দুই বিকল্পের কোনটি কার্যকরী হবে, তা নির্ভর করবে বিশ্বের গড় ঘনত্বের উপরে। বিশ্বের ঘনত্ব একটা সন্ধিমানের বেশি হলে মহাকর্ষ বল সম্প্রসারণ বলের ওপর প্রাধান্য লাভ করবে এবং বিশ্ব অবশেষে ধ্বসে পড়বে।
বিশ্বের গড় ঘনত্বের সন্ধিমান হল প্রতি ঘন সেন্টিমিটারে ২ x ১০-২৯ গ্রাম। বিশ্বের গড় ঘনত্ব এই সন্ধিমানের (Critical value) চেয়ে বেশি হলে বিশ্বের পরিণতি বিরাট ধ্বস। আর কম হলে বিশ্ব সর্বদা উন্মুক্ত থাকবে।
বিশ্বের সমস্ত প্রকার স্তর বিষয় জানা থাকলে গড় ঘনত্ব নির্ণয় করা যেত এবং অন্তিম অবস্থায় বিশ্ব কেমন হবে, বিরাট ধ্বসের শিকার হবে, না ক্রমাগত সম্প্রসারণে সমস্ত তেজ হারিয়ে তাপের অভাবে বিশ্বের মৃত্যু ঘটবে, তা বলা যেত ৷
বিবর্তনশীল বা স্থিতাবস্থাশীল মহাবিশ্বের দুটি ধারণার মধ্যে কোনটি সঠিক, তা বিচারের জন্য কোয়াসারকে মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
বর্ণচ্যুতি (Red Shift)
ধরা যাক, কোয়াসার থেকে আসা আলোর বর্ণালীর লাল রঙের প্রান্তে যে বর্ণচ্যুতি (red shift) আমরা ঘটতে দেখি তা কোয়াসারের বিপুল বেগের জন্যই ঘটে।
এতে বোঝা যায় যে, এই মহাবিশ্বের সুদূর অঞ্চলেই কোয়াসারের সংখ্যা অনেক বেশি, আমাদের কাছাকাছি অঞ্চলে আদৌ কোন কোয়াসার নেই ।
অর্থাৎ, সুদূর অতীতে মহাবিশ্বের সমগ্র অঞ্চল জুড়েই কোয়াসার যথেষ্ট সংখ্যায় ছিল। সোজা কথায় মহাবিশ্বের চেহারাটাই ক্রমাগত পরিবর্তিত হয়ে চলছে। আর আমরা বিবর্তনশীল মহাবিশ্বেই বাস করছি ধরে নিতে হবে।
১৯৭০ দশকের গোড়ায় হয়েল তার স্থিতাবস্থাশীল তত্ত্বকে রক্ষা করার জন্য এক নতুন কথা বললেন। মহাকাশে কোন মহাজাগতিক বস্তুর অভিকর্ষের প্রভাবে চারপাশে ক্ষেত্র ও সময়ের পরিমাপের মধ্যে যে বক্রতার সৃষ্টি হচ্ছে তা যেন এক একটি গর্তের মত।
এই গর্তের মধ্য দিয়ে আসতে গিয়ে আলোর বর্ণালীর লাল রংয়ের প্রান্তে যে বর্ণচ্যুতি ঘটে তার মধ্য দিয়ে সময়ের গতির মন্দীভবনের (ধীরে চলার) ছবিটাই ধরা পড়েছে।
কোয়াসাকে আলোর বর্ণালীর লাল রঙের প্রান্তে যে বর্ণচ্যুতি ঘটছে তা যদি কোয়াসারের ভর বা অভিকর্ষ বলের জন্যই ঘটে থাকে তাহলে বলা যায় যে কোয়াসাররা আমাদের কাছাকাছিই রয়েছে, দূরে নয়। মহাবিশ্বের চেহারাটা কাছে ও যেমন, দূরেও তেমনি।
অভিকর্ষজনিত এই বর্ণচ্যুতির নাম দেয়া হয়েছে gravitational red shift, আর জ্যোর্তিবিদ্যার ক্ষেত্রে বর্ণালীর লাল রঙের প্রান্তে যে বর্ণচ্যুতি তা Cosmological red shift নামে পরিচিত। যাক হয়েলের ধারণাটি শেষ পর্যন্ত টিকেনি।
তিনরূপে মহাবিশ্ব
বিগ ব্যাঙের মধ্যদিয়ে সৃষ্টি হবার পর মহাবিশ্বের চেহারাটা তিনটি সম্ভাবনার মধ্যে কোন সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে চলেছে তা জানা নেই। কেননা প্রথম বিস্ফোরণের মধ্যে কি পরিমাণ শক্তি জমা ছিল তা অজ্ঞাত। এবার আমরা তিন সম্ভাবনার কথা বলব ।
প্রথমত মহাবিশ্বের সৃষ্টির মুহূর্তে বিস্ফোরণের ধাক্কাটা শক্তির মাঝে যদি যথেষ্ট জোরালো না হয়ে থাকে, তা হলে তারাজগতের বলে প্রসারণের ধাক্কায় অনেক দূরে গিয়ে হাজির হবে ঠিকই, কিন্তু সুদূর ভবিষ্যতে প্রসারণের সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছে মহাবিশ্বের সমগ্র বস্তু আবার একই জায়গায় গুটিয়ে আসতে থাকবে।
গ্যালাক্সিগুলোর আলোর বর্ণালীর লাল রঙের প্রান্তে বর্ণচ্যুতির জায়গায় সেটা ঘটবে নীল রঙের প্রান্তে। তারপর দশ হাজার কোটি বছর বাদে মহাবিশ্বের সমগ্র বস্তুর গুটিয়ে আসা পিওটার মধ্যে বিগ ব্যাঙের মতই আর একটি বিস্ফোরণ ঘটে বসবে;
দ্বিতীয় সম্ভাবনার রূপটা হতে পারে এ রকম মহাবিশ্বের প্রাথমিক বস্তুপিণ্ডের বিস্ফোরণের মধ্যে হয়তো যে পরিমাণ শক্তি নিহিত ছিল, তার সাহায্যে তারাজগতের দল পরস্পরের অভিকর্ষ বলের টানকে কাটিয়ে উঠতে পেরেছিল।
এরকম একটি অবস্থায় মহাবিশ্ব গুটিয়ে গিয়ে আবার একটি প্রাথমিক বস্তুপিণ্ডে পরিণত হবে না। বরং সুদূর ভবিষ্যতে, তারাজগতের দল যখন পরস্পরের কাছ থেকে প্রায় এক অসীম দূরত্বে গিয়ে হাজির হবে, তখন ওদের ছুটে চলার বেগটাও কমতে কমতে একদিন স্তব্ধ হয়ে আসবে।
মহাবিশ্বের সৃষ্টিলগ্নে বিস্ফোরণের শক্তি
তৃতীয় সম্ভাবনাটা হল এই মহাবিশ্বের সৃষ্টিলগ্নে হয়তো বিস্ফোরণের শক্তি ছিল এতটাই জোরালো, যার সাহায্যে তারাজগতের দল পরস্পরের অভিকর্ষের বাধন থেকে মুক্ত হবার মত যথেষ্ট বেগ অর্জন করতে পেরেছিল। এমনকি সুদূর ভবিষ্যতেও পরস্পরের কাছ থেকে ক্রমাগতই দূরে সরে যেতে থাকবে। অর্থাৎ কিনা মহাবিশ্ব ক্রমাগতই প্রসারিত হতে থাকবে।
১৯৭৫ সালে বিখ্যাৎ গনিতজ্ঞ এলিস জানালেন, মহাবিশ্ব সৃষ্টির মুহূর্তে Singularity বা একটি মাত্র বিন্দুতে সমস্ত বস্তুর জড়ো হওয়া জাতীয় একটি ঘটনা থাকতেই হবে এমন কোন কথা নেই।
অনেক আগে থেকে সৃষ্টি লাভ করা কোন মহাবিশ্ব থেকে বস্তু হয়তো দিগন্ত পেরিয়ে আমাদের মহাবিশ্বে পৌঁছোচ্ছে। এর চাপ, তাপ, ঘনত্ব অসীম অঙ্কে আকার কোন প্রয়োজন নেই। সোজা কথায় মহাবিশ্ব সৃষ্টির সময় বিগ ব্যাঙ জাতীয় কোন ঘটনাই ঘটেনি।
চিরবিদ্রোহী হয়েল ১৯৭৫ সালের শেষের দিকে আরও একটি বিপ্লবী তত্ত্ব হাজির করে বসলেন । তার নতুন মতে মহাবিশ্ব নাকি প্রসারিত হচ্ছে না।
আসলে যে মাপকাঠি দিয়ে আমরা সবকিছু পরিমাপ করছি, সময়ের ব্যবধানে তার দৈর্ঘ্যটাই নাকি পালটে যাচ্ছে অর্থাৎ যে আলোকবর্ষ নিয়ে আমরা মহাকাশের বিভিন্ন বস্তুর পারস্পরিক দূরত্বকে পরিমাপ করছি।
তার দৈর্ঘ্যটাও সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছোট হতে থাকবে। মহাবিশ্বের বয়স যতো বড় হতে থাকবে, তত দুটো তারাজগতের মধ্যকার দূরত্ব আলোকবর্ষের মাপে বেড়ে চলবে। এর স্বপক্ষে পরীক্ষামূলক প্রমাণ কিছু নাই।
মহাবিশ্বের গঠন সম্পর্কে দুটি সোভিয়েত মতবাদ (মহাবিশ্বের সৃষ্টির সময়ের)
সোভিয়েত এস্তোনিয়ার (এতদিনে সোভিয়েত রাষ্ট্র ভেঙে গেছে ১৯৯১ সনে, এস্তোনিয়া স্বাধীন রাষ্ট্র এখন) বিজ্ঞানী জান আইনাস্টো অসীম বিশ্বের ধারণাকে অমূলক বলে প্রমাণ করেছেন।
তিনি বলেন বিশ্বের কোন সীমানা নেই, আকার নেই ইত্যাদি মতামত বিজ্ঞানের কল্যাণে এখন আর সত্য নয়। দেখা গেছে মহাবিশ্বের একটা বিরাট অংশে কোন গ্যালাক্সি নাই—বেশ জায়গা খালি।
নতুন তথ্য থেকে জানা যায় গ্যালাক্সিগুচ্ছেরাও একটা বিরাট মৌ-কলোনীর কোঠায় দেয়ালে ঘেষে অবস্থান করে। এরকম একটা কোঠার একদিকের দৈর্ঘ্য (প্রস্থ, উচ্চতাও তদ্রুপ) হচ্ছে ১০০ বিলিয়ন আলোকবর্ষ।
মনে হচ্ছে দু দেয়ালের মাঝে আর গ্যালাক্সিগুলো অবস্থান নেয় না। এ জায়গাগুলি খালি । এরকম বেশ কিছু খালি জায়গা আবিষ্কৃত হয়েছে।
৩০০ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরত্বের মধ্যে কোন গ্যালাক্সি নাই
এরকম একটা শূন্যস্থান পাওয়া গেছে। একটি বিন্দু থেকে তিন দিকে তিনটি সরলরেখা ধরে এগোলে দেখা গেছে যে ৫০০ বিলিয়ন আলোকবর্ষ পর্যন্ত মহাকাশে গ্যালাক্সিপুঞ্জ রয়েছে, তবে তারপর ৮০০ বিলিয়ন আলোকবর্ষ পর্যন্ত আবার খালি। তারপর আবার তারকাজগতের ভিড়। এরকম চিত্র।
মহাবিশ্বের মহামৌচাকের এক একটি কোঠার ব্যাসার্ধ গড়ে ১০০-২০০ মেগাপারসেক (মেগা = মিলিয়ন = ১০ লাখ) ছায়াপথগুলো দিয়ে কোঠার দেয়ালগুলি গঠিত। মাঝে যেখানে মৌমাছিটা থাকার কথা, ‘ওই জায়গাটাই খালি।
এরকম গঠন দেখে মনে হচ্ছে কোঠাটাই আগে তৈরি হয়েছিল, তারপর গ্যালাক্সিগুলো উদ্ভূত হয়। বিশ বিলিয়ন বৎসর আগে খুব দ্রুত মুহূর্তের মধ্যে (সময়হীন বিরামকাল) ইলেকট্রন, নিউট্রন, প্রোটন, বেরিয়ন এবং অন্যান্য কণিকাগুলি জন্ম নেয় বিরাট বিস্ফোরণের পরপরই। আজও আমরা প্রসারণশীল বিশ্বে বাস করছি।
আবার হবে সঙ্কোচন, বিন্দুতে উপনীত হবে মহাবিশ্ব, আবার বিস্ফোরণ
এ সবের পিছনে কারণটা হল পদার্থের ঘনত্ব। সোভিয়েত (তথা রুশ) পদার্থবিদ মারকভ এক নতুন থিয়োরীতে বলেন যে, ক্ষুদ্রবস্তুর (কোয়ান্টাম ধারণার) পর্যায়ে বিশ্ব অসংখ্য পরিবর্তনশীল বিশ্ব নিয়ে গঠিত ।
তাদের পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে এক জটিল পর্যায়ের যা দেশ-কালের সংজ্ঞা দিয়ে বোঝা যায় না। এ ধরণের বিশ্বের গঠন সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নাই।
এতে বলা হয় যে একটি ছোট বস্তু বিরাট এক বিশ্বকে ধারণ করতে পারে। একটি ইলেকট্রন যেমন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একটি অংশ, তেমনি আমাদের বিশ্বব্রহ্মাণ্ডও অসংখ্য বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অংশ বিশেষ ।
ফল দাঁড়ায় এই যে এক বিশ্বব্রহ্মাণ্ড (একটি সিস্টেম) অন্য বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ভিতর প্রবেশ করতে পারে তাতে কারোরই কোন অনিষ্ট হয় না—তাদের পারস্পারিক সম্পর্কটাই এমন জটিল শক্তি দিয়ে পরিবেষ্টিত।
মেগাকসমিক এবং মাইক্রোকসমিক পর্যায়ে এইসব বিশ্বব্রহ্মাণ্ডগুলি পারস্পরিক বন্ধনে আবদ্ধ এবং এক মহাঐক্যের তানে জীবন বয়ে চলেছে।
কি দুঃসাহসিক কল্পনা যে একটি ইলেকট্রন, প্রোটন বা পিনের ডগার মধ্যে হাজার কোটি আলোক বৎসরের এক একটি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড লুকিয়ে আছে। মজার কথা পদার্থবিদ্যার কোন সূত্রই এই ধারণার বিরোধিতা করে না ।
ক্ষুদে কৃষ্ণগহ্বর
ব্রিটিশ পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং (জন্ম ১৯৪২) এক মারাত্মক রোগে আক্রান্ত থেকেও (বিটিভির রিপ্লেজ বিলিভ ইট অর নট’ প্রোগ্রামে তাকে দেখানো হয়েছিল গত বন্যার (১৯৮৮) সময়) বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিতথ্য নিয়ে কিছু গাণিতিক সমস্যার সমাধান দেন যা আইনস্টাইন পরবর্তী যুগে যুগান্তকারী বলে পরিচিত। হকিং সম্পর্কে পরে আমরা আলোচনা করব।
স্টিফেন হকিং ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির প্রথম লগ্নে কিছু বিচিত্র ঘটনার সম্ভাব্যতা সম্বন্ধে আলোকপাত করেছেন। ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি যদি আনুমানিক দু হাজার কোটি বছর আগেই ঘটে থাকে, তাহলে সৃষ্টির এক সেকেন্ড বাদেই অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বস্তুপিণ্ড ব্রহ্মাণ্ডময় গড়ে উঠেছিল।
যে ভয়ংকর এলোপাতাড়ি ঘটনা স্রোতের মধ্যদিয়ে ব্রহ্মাণ্ডের জীবন শুরু হয়েছিল, তাতে, ঐ ক্ষুদ্র বস্তুপিণ্ডদের চুর্নীকৃত হয়ে এক একটি ক্ষুদে (মিনি) ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বররূপী নক্ষত্রে রূপান্তরিত হয়ে বসে থাকবার কথা।
অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণাদের আচরণবিধি হল কোয়ান্টাম বলবিদ্যার বিষয়ীভূত ব্যাপার
পদার্থবিদরা পরমাণু ও পরমাণু কেন্দ্রকের ধর্মাধর্ম নির্ণয়ের জন্য এই বলবিদ্যার নিয়ম- কানুনের সাহায্য নিয়ে থাকেন।
হকিং ১৯৭৫ সাল নাগাদ কোয়ান্টাম বলবিদ্যার তাত্ত্বিক পদ্ধতির সাহায্যে প্রমাণ করলেন যে ক্ষুদে কৃষ্ণ গহ্বরেরা নাকি বস্তুকণা ও আলোর বিকীরণ ঘটিয়ে থাকে।
বিকীরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ওরা আরো ছোট হতে থাকে এবং সেই সঙ্গে শক্তির অপচয়ও ঘটতে থাকে দ্রুত বেগে। শেষ পর্যন্ত এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে ওদের জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে।
দশ লক্ষ টন পর্যায়ের হাইড্রোজেন বোমার বিস্ফোরণের মিলিত শক্তির সঙ্গে হয়তো ক্ষুদে কৃষ্ণ গহ্বরের বিস্ফোরণের শক্তির মাপের খানিকটা মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। যে সব ক্ষুদে কৃষ্ণ গহ্বরের ভর ১০০ কোটি টনের কম, ওরা কেউ আর বেচে নেই।
কৃত্রিম উপগ্রহে জোরালো মাপের গামারশ্মির বিকীরণ ধরা পড়ছে। এই রশ্মির উৎস কৃষ্ণগহ্বরের মৃত্যুকালীন জবানবন্দী হতে পারে। আমাদের সৌরজগতের মধ্যেও হয়তো এই ক্ষুদে কৃষ্ণগহ্বরেরা রয়েছে।
মহাবিশ্বের জ্যামিতিক চেহারা (মহাবিশ্বের সৃষ্টির সময়ের)
তিন ধরণের সম্ভাব্য বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি।
১. বর্তুলাকৃতি, মহাবিশ্বের বক্রতা (বস্তুর অভিকর্ষের প্রভাবে ক্ষেত্র ও কাল বক্রতা লাভ করে) বর্তুলের আকারে ঘুরে এসে সম্পূর্ণ হবার ফলে এই বক্রতাকে বলে পজিটিভ। বস্তুর গড় ঘনত্ব ক্রান্তি মাত্রার চেয়ে বেশি হয় ।
২. সমতলীয় মহাবিশ্ব, বক্রতা শূন্য। বস্তুর গড় ঘনত্ব ক্রান্তি মাত্রার সমান হয় । ৩. পরাবৃত্তাকার মহাবিশ্ব, বক্রতা সম্পূর্ণ না হয়ে ক্রমেই ছড়িয়ে যাবে দুদিকে, তাই তার মাত্রা হবে নেগেটিভ। এখানে বস্তুর গড় ঘনত্ব ক্রান্তিমাত্রিক মাত্রা’ থেকে কম হয় ।
মহাবিশ্বের জ্যামিতিক চেহারা যদি সমতলীয় বা পরাবৃত্তাকার যেকোন একটি হয় তাহলে সে হবে এক অসীম, অনন্ত মহাবিশ্ব । এর যেমন কোন নির্দিষ্ট প্রান্ত নেই, তেমনি কোন বৃত্তও নেই । উপরের তিন প্রকৃতির মহাবিশ্বের কোনটি যে আমাদের মহাবিশ্ব, তারই অনুসন্ধান করে চলেছেন বিজ্ঞানীরা। শেষ কথা বলার সময় এখনো আসেনি ।
পদার্থবিদ হকিংয়ের সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী মহাবিশ্বে ক্ষুদে শ্বেত গহ্বরের অস্তিত্ব যদি সত্য হয়, তাহলে চূড়ান্তভাবে হতাশ হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না।
কোন বস্তু যখন কৃষ্ণ গহ্বরের মধ্যে গিয়ে পড়ে, তখন বস্তুটির সমস্ত তথ্য মহাবিশ্ব থেকে লোপাট হয়ে যায়। কিন্তু শ্বেত গহ্বর এমন বস্তু যার মধ্য দিয়ে ক্রমাগত নতুন নতুন তথ্য আমাদের মহাবিশ্বে এসে জড়ো হতে থাকবে—
ওরা যেন হল তথ্যের ভাণ্ডার । নতুন তথ্য যদি ক্রমাগত আমাদের মহাবিশ্বে এসে হাজির হতে থাকে, তাহলে কোন কিছু সম্বন্ধেই সঠিকভাবে আর আমরা ভবিষ্যৎবাণী করে উঠতে পারব না।
মহাবিশ্বের শেষ পরিণতি (মহাবিশ্বের সৃষ্টির সময়ের)
বিশ্বের এখন যৌবনকাল। কিন্তু একদিন এ যৌবন অতিক্রান্ত হবে, বার্ধক্য আসবে। অবশেষে মৃত্যু এসে এ বিশ্বকে মুছে দেবে। ছায়াপথসমূহও মরণশীল, এরাও জরায় আক্রান্ত হয় এবং শেষ তারাটি জ্বলে পুড়ে নিঃশেষ না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত ছায়াপথসমূহ অতি দীর্ঘ ভয়াবহ শীতল মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করবে।
যে তিন ধরণের বিশ্বের কথা আমরা বলেছি তার মধ্যে যদি মনে করা যায় যে, সুদূর ভবিষ্যতে মহাকর্ষ বলই প্রাধান্য লাভ করবে, তাহলে সেই বিরাট ধ্বসের সময়সূচি আমরা নির্ণয় করতে পারি।
ছায়াপথের ভিতরে পরস্পরের আকর্ষণ বল বা মহাকর্ষ বল বিশ্বের সম্প্রসারণ বেগকে শ্লথ করতে চেষ্টা করে। এটা হচ্ছে সম্প্রসারণশীল বিশ্বের ভরবেগ এবং মহাকর্ষ বলের মধ্যে টানাপোড়েন। ছায়াপথের ভর বেগের পরিমাণ বেশি হলে বিশ্ব অনন্তকাল পর্যন্ত বাড়তে থাকবে।
আমেরিকার বৈজ্ঞানিক ফ্রিম্যান ডাইসন শেষের সেই ভয়ঙ্কর দিনের নিম্নরূপ চিত্র এঁকেছেন। বিরাট ধ্বসের একশত কোটি বৎসর পূর্বে একত্রে অপসারণশীল ছায়াপথ স্তবকগুলোর ভেতরের খালি জায়গা ভরাট হয়ে আসতে থাকবে।
ঐ ধ্বসের ১০ কোটি বৎসর পূর্বে পৃথক পৃথক ছায়াপথের ভিতরের জায়গা কমে গিয়ে সমস্ত ছায়াপথ একীভূত হয়ে যাবে
সারা বিশ্বে তখন তারায় তারায় খচিত, রাত্রি দিনের কোন পার্থক্য থাকবে না। মহাকর্ষ বল বেড়ে যাবে । তারাসমূহ পরস্পরের কাছে চলে আসবে।
বিরাট ধ্বংসের ১ লাখ বৎসর আগে সারা আকাশ প্রচণ্ড গরম হয়ে উঠবে। বিশ্বের কোন গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব থাকবে না। সমুদ্রের জল বাষ্প হয়ে যাবে।
অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তারাদের তাপে সমস্ত কঠিন শিলা গলে ফুটে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। বিরাট ধ্বসে বিশ্ব লোপ পাবার এক হাজার বৎসর পূর্বে তারাদের ভিতর প্রচণ্ড সংঘর্ষ ঘটবে এবং কালো গহ্বরের সৃষ্টি করবে।
বিরাট ধ্বসের শেষ অঙ্কে কালোগর্তেরা সব একত্রিত হয়ে একটাতে পরিণত হবে। আর এই একটার ভিতরে একদা বিশাল বিশ্বের সমস্ত পদার্থ ও তেজ একটা অতি ক্ষুদ্র, অতি ঘন, অতি উত্তপ্ত অগ্নিপিণ্ডে পরিণত হবে;
বিরাট ধ্বসের সঙ্গে সঙ্গেই আবার একটি বিরাট বিস্ফোরণও ঘটবে এবং নতুন একটা বিশ্বের সৃষ্টির সূচনা করবে। বিরাট এ ধস ঘটবে এখন থেকে ১ লক্ষ কোটি বৎসর পরে। এরও ১ লক্ষ কোটি বৎসর পরে নতুন ঘটনার সূচনা হবে।
ভিক্টোরিয়ান যুগের মানুষ বিশ্বকে একটা দম দেয়া ঘড়ির সঙ্গে তুলনা করতেন। সেটা একবার চাবি দেয়া হলে চলতে থাকবে এবং ক্রমাগত চালনা শক্তি হারাতে থাকবে; সবশেষে এক সময় এর চাকা ঘোরা বন্ধ হয়ে যাবে। বিশ্বের সমস্ত ক্রিয়াকলাপ শেষ হয়ে যাবে।
কালো গহ্বরের বিস্ফোরণের পর এই সমস্ত ‘এককত্ব’ বিশ্বে নগ্ন অবস্থায় ঘুরতে থাকবে (মহাবিশ্বের সৃষ্টির সময়ের)
কোন কোন আধুনিক বৈজ্ঞানিক মনে করেন, এমন কিছু ঘটতে পারে, যাতে ঘড়ির স্প্রিংকে ধাক্কা দিয়ে চালিয়ে দেয়া যেতে পারে এবং সেই বিন্দু হচ্ছে কালো গহ্বরের কেন্দ্রে অবস্থিত “এককত্ব” । কালো গহ্বরের বিস্ফোরণের পর এই সমস্ত ‘এককত্ব’ বিশ্বে নগ্ন অবস্থায় ঘুরতে থাকবে। এরা একেবারে শূন্য থেকে তেজ, আলো, তাপ সৃষ্টি করতে পারে। এরা বিজ্ঞানের বিধি মানে না, আপনা আপনি বস্তু গঠন করতে পারে । বিশ্ব হয়তো একটা নতুন অস্তিত্বের নতুন স্তরে উপনীত হবে ।
মানুষ যদি সময়কে জয় করতে পারে, তাহলে সে হয়তো ছায়াপথে বসতি স্থাপন করবে, পালসার ও কালো গহ্বরকে নিয়ন্ত্রণ করবে, হয়তো বা অতি রহস্যময় এককত্বকে পোষ মানিয়ে, বিশ্ব ঘড়ির বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রতিরোধ করবে।
লক্ষ কোটি বৎসর পরে আমাদের ছায়াপথের শেষ তারাটিও যখন নিভে যাবার উপক্রম হবে তখন হয়ত মানুষ অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে এই ধ্বংসলীলা দেখবে না;
মানুষই হয়তো এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে সক্ষম হবে। মার্কিন কল্পবিজ্ঞান লেখক আইজ্যাক আসিমভের “শেষ প্রশ্ন” নামে এ ব্যাপারে বেশ মজাদার একটি বৈজ্ঞানিক কল্প কাহিনী আছে যা লেখক কর্তৃক অনূদিত হয়ে ‘মহাকাশ বার্তায়’ প্রকাশিত হয়েছিল।
মহাবিশ্বের মহাশূন্যের মহাসমুদ্রে মহাকালের ভেলায় আমরা সবেমাত্র পা রেখেছি । মানুষ মহাকালের অজানা রহস্যকে অবশ্যই জয় করতে পারবে—সেও কেবল মহা সময়ের ব্যাপার।
বন্ধুরা এই ছিল আপনাদের জন্য মহাবিশ্বের সৃষ্টির সময়ের রথে যাত্রা হল শুরু সংক্রান্ত আর্টিকেল। সময়ের বিচিত্র কাহিনী ও মহাকালের অজানা রহস্য সিরিজ এর অন্যান্য আর্টিকেল পড়তে আমাদের এই ক্যাটাগরী ফলো করুন। সবার আগে আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজ এবং ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করে নিন।