Sign In

বিভিন্ন শিখন তত্ত্বের প্রাথমিক ধারণা

বিভিন্ন শিখন তত্ত্বের প্রাথমিক ধারণা

রিচ টু টিচ: গণিত শিখন-শেখানো মডিউল-০১; নিবন্ধ-০২, বিভিন্ন শিখন তত্ত্বের প্রাথমিক ধারণা নিয়েই আজকের আলোচনা। এই পাঠ থেকে আপনি বিভিন্ন শিখন তত্ত্বের প্রাথমিক ধারণা নিয়ে বিস্তারিত জানতে পারবেন।

গত পর্বে আমরা আলোচনা করেছিলাম মাধ্যমিক শিক্ষা ও শিখন-শেখানো কার্যক্রম সংক্রান্ত বিষয়ে যাতে ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণির গণিত এর পাঠদান এবং শিখন শেখানো বিষয় দেখানো হয়েছে।

বিভিন্ন শিখন তত্ত্বের প্রাথমিক ধারণা

শিক্ষকের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল শিক্ষার্থীদের শিখনে সহায়তা করা। শিক্ষার্থী কিভাবে শিখে, কোন বিষয়গুলো শিক্ষার্থীর শিখনকে সক্রিয় এবং স্থায়ী করে সেগুলো নির্ভর করে শিক্ষকের আচরন, শিখন-শেখানো পদ্ধতি ও কৌশলের উপর।

শিক্ষার্থীর এই শিখন নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন তত্ত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে। এই ভিডিওতে সেই তত্ত্বগুলো থেকে জ্ঞানমূলক বিকাশ মতবাদ, চিরায়ত সাপেক্ষীকরণ তত্ত্ব এবং সামাজিক গঠনবাদ তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

জ্ঞানমূলক বিকাশ মতবাদ

শিখনের ক্ষেত্রে একজন মানুষের মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে তা নিয়েই এই জ্ঞানমূলক মতবাদ। মানুষের শিখার ক্ষেত্রে তার চারপাশের নিয়ামকগুলো কিভাবে তার শিখনকে প্রভাবিত করে তা নিয়ে জ্ঞামূলক বিকাশ মতবাদ আলোচনা করে।

সুইশ বিজ্ঞানী জ্যা পিঁয়াজে
সুইশ বিজ্ঞানী জ্যা পিঁয়াজে

সুইশ বিজ্ঞানী জ্যা পিঁয়াজে- একটি শিশুর জ্ঞান বিকাশ কিভাবে ঘটে সে বিষয়ে একটি মতবাদ প্রদান করেন।

তার মত অনুসারে – মানুষ বা প্রাণি নিজের জ্ঞানবুদ্ধি প্রয়োগ করে শিখে।

মানুষ যখন একটি সমস্যার মুখোমুখি হয় তখন সে সেটি প্রত্যক্ষ করে তার অভিজ্ঞতা এবং দৃষ্টভঙ্গির আলোকে সমাধানের দিকে এগিয়ে যায়।

পিঁয়াজের এই মতবাদটি “Theory of Cognitive Development”- নামে বহুল পরিচিত।

এই মতবাদ অনুসারে শিখনের তারতম্য অনুসারে ১ থেকে ১৬ বছর পর্যন্ত বয়সী শিশুর জীবনকে চারটি স্তরে ভাগ করা হয়েছে। শিশুর জীবনে বিকাশের চারটি স্তরঃ

ক) ০-২ বছর- সংবেদন সঞ্চালনের স্তর

খ) ২-৭ বছর- প্রাক কার্যকর স্তর

গ) ৭-১১ বছর- বাস্তব কার্যকর স্তর

ঘ) ১১-১৬ বছর – অনুষ্ঠানিক কার্যকর স্তর

জ্ঞানমূলক বিকাশ মতবাদ
জ্ঞানমূলক বিকাশ মতবাদ

একটি শিশু কোন বয়সে কতটুকু ধারন করতে পারবে সেটি বিবেচনায় রেখে শিশুর শিখনের বিষয়বস্তু এবং তার শিখন কার্যক্রম নির্বাচন করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই মতবাদ অনুসারে শিক্ষক শিক্ষার্থীর শিখনকে সক্রিয় করতে শিক্ষার্থীর মধ্যে-

১. কোন কিছু নিয়ে প্রশ্ন

২. অনুসন্ধান মূলক চিন্তা

৩. আবিষ্কারের বাসনা, ইত্যাদির সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেন।

এক্ষেত্রে উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে- ষষ্ঠ শ্রেণিতে গণিতে অংকপাতনের শিখার সময় দেশের আয়তন নিয়ে কাজ করা যেতে পারে। এতে নিজ দেশের আয়তন থেকে আরো বড় কিংবা ছোট আয়তনের কোন কোন দেশ আছে তা শিক্ষার্থীরা খুঁজে বের করবে।

পিঁয়াজের মতবাদের গুরুত্ব এবং ব্যবহার

শিখনের ক্ষেত্রে পিঁয়াজের এই জ্ঞান বিকাশমূলক মতবাদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ-

ক. বাংলাদেশের মাধ্যমিকের শিক্ষাক্রম প্রনয়ণে এই মতবাদ ব্যবহার করা হয়েছে। এই মতবাদ অনুসরণ করে শিক্ষার্থীর বয়স অনুযায়ী তার অনুধাবন ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে বিষয় এবং পাঠ নির্বাচন করা হয়েছে।

খ. শিখন-শেখানো পদ্ধতি নির্বাচনেও এই মতবাদ অনুসরণ করা হয়েছে৷ যখন শিক্ষার্থীর বিকাশের স্তর অনুযায়ী শিখন কার্যক্রম পরিচালিত হয় তখন শিখন- শেখানো প্রক্রিয়া সহজ এবং কার্যকর হয়।

গ. এই মতবাদ অনুসারে শিখন একটি স্বতস্ফূর্ত সক্রিয় প্রক্রিয়া। শিক্ষার্থী স্বতস্ফূর্ত ভাবে অংশগ্রহন না করলে সেখানে সক্রিয়তা আসে না । এতে শিক্ষার্থীর মানসিক গঠন ব্যহত হয় যার ফলে শিক্ষার্থীর শিখন স্থায়ী হয় না। এই বিষয়টি বিবেচনা করে আমাদের শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি করা হয়েছে।

পিঁয়াজের মতবাদ অনুসারে আমরা বুঝতে পারছি শিক্ষার্থীকে কোন কিছু শিখতে চাপ প্রয়োগ না করে বরং কিভাবে শিক্ষার্থী সক্রিয় এবং স্বতস্ফূর্তভাবে শিখবে তার দিকে আলোকপাত করতে হবে এবং শিক্ষার্থীকে সমাধান করার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে।

চিরায়ত সাপেক্ষীকরণ তত্ত্ব

রাশিয়ান শরীরতত্ত্ববিদ আইভান প্যান্ড্রন্ড এই তত্ত্বের প্রবর্তক। সাপেক্ষীকরণ তত্ত্বের মূল বিষয় বস্তু সহজ করে বলতে গেলে বলা যায় –

একটি নিরপেক্ষ উদ্দীপক দ্বারা এমন একটি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করা যা মূলত অন্য একটি উদ্দীপক দ্বারা সৃষ্টি হয়।

আইভান প্যান্ড্রন্ড

একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে – মনে করি শিক্ষার্থীদের চতুর্ভুজের আকৃতির সাথে পরিচিত করা হবে। এক্ষেত্রে বই, ব্ল্যাক বোর্ড, যেকোন বাক্স ইত্যাদি দেখিয়ে শিক্ষক যদি বলে এই চার কোনা আকারটি চতুর্ভুজ। তখন শিক্ষার্থী যেকোন চার কোণা আকৃতিকে চতুর্ভুজ হিসেবে চিহ্নিত করবে।

শ্রেণিকক্ষে এ তত্ত্বের ব্যবহার

ক. শিখনের ক্ষেত্রে প্যাভলভের এই সাপেক্ষীকরণ তত্ত্বের গুরুত্ব অনেক। এই তত্ত্ব অনুযায়ী শিক্ষার্থীর অর্জিত অভ্যাস শিক্ষা, শৃংখলাবোধ ইত্যাদি সব কিছুই একধরনের অবিচ্ছিন্ন সাপেক্ষ পরিবর্তী ক্রিয়া।

খ. শিক্ষার্থীর আবেগিক বিকাশের ক্ষেত্রে এই সাপেক্ষিকরণের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি দেখা যায়৷ বিদ্যালয়ে শিক্ষকের আচরণ যদি শিক্ষার্থীদের শিখনের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে যেমন, শিক্ষার্থী যদি শিক্ষুকে ভয় পায় তাহলে ঐ বিষয়ের শিখনে অনীহা তৈরি হতে পারে।

গ. আবার, শিক্ষকের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব শিক্ষার্থীকে ঐ বিষয়ে পাঠে আগ্রহী করে তোলে।

সামাজিক গঠনবাদ তত্ত্ব

মানুষের মধ্যে যখন শিখন হয় তখন মানুষের জ্ঞানীয় স্তরে নতুন জ্ঞান জমা হয়। এক্ষেত্রে বলা যায় মানুষের জ্ঞানগুলো স্তরে স্তরে গঠন হয়ে থাকে। পূর্বজ্ঞানের আলোকে নতুন জ্ঞানের গঠন হয়ে থাকে। এটি শিখন তত্ত্বে গঠন বাদ;

১৯৩০-শতকের দিকে রাশিয়ান মনোবিজ্ঞানী ভাইগটস্কি এই গঠনবাদ তত্ত্বের আরো উন্নয়ন করেন। তার মতানুসারে, মানুষের বিকাশ মূলত হল- মানসিক বিকাশ। সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে এই বিকাশ ঘটে থাকে।

ভাইগটস্কির মতে এই মিথস্ক্রিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল ভাষা। শিশুর বিকাশ তার ভাষার উপর নির্ভরশীল। একটি শিশুর ধারণার বিকাশ তখনই ঘটে যখন সে তার পর্যবেক্ষন করা বিষয়টিকে বুঝিয়ে বলতে পারে। তখন শিশু সচেতনভাবে শিখতে পারে।

মতবাদের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে

১. শিশুর শিখনে তার আশে পাশের উচ্চ যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যাক্তির প্রভাব থাকে৷ শিশুর মা, বাবা ভাই-বোনের কাছ থেকে সে নতুন নতুন জ্ঞান, তথ্য জানতে বুঝতে ও শিখতে পারে। শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে এই উচ্চতর যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তি হল শিক্ষক। তার কাছ থেকে শিক্ষার্থী নতুন জ্ঞান বা তথ্যের সাহায্যে তার শিখনের বিকাশ ঘটায়।

২. জ্ঞানমূলক বিকাশের কার্যকারিতা একটি সুনির্দিষ্ট সীমার মধ্যে আবদ্ধ। এটি Zone of Proximal Development বা প্রান্তসীমা ধারণা নামে পরিচিত। এই বিকাশ শিক্ষার্থীর সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার উপর নির্ভর করে। শিখনের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী যতবেশি শিক্ষকের সান্নিধ্যে আসবে এই প্রান্তসীমা তত বৃদ্ধি পাবে। অর্থাৎ ZPD এর বিকাশ তত গভীর হবে।

৩. বিকাশ মতবাদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল অর্জিত জ্ঞানকে দৃঢ় করা বা স্থায়ী করা। এটি হল দৃঢ়করণ তত্ত্ব বা স্ক্যাফোল্ডিং (scaffolding)। কিভাবে জানা জ্ঞান বা ধারণাকে অজানা জ্ঞানের দিকে নিয়ে জ্ঞানের বিকাশ করতে হয়। এর ফলে লব্ধ জ্ঞান আরো বেশি দৃঢ় হয় এবং নতুন জ্ঞানের সমন্বয়ে জ্ঞানের বিস্তৃতি ঘটে।

৪. আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থিদের কোন একটি বিষয় অনুধাবন করতে সমস্যা হলে শিক্ষক নিজে থেকে তাকে সহায়তা করতে পারেন কিংবা সহপাঠিদের মধ্যে যে ভালো জানে তার সাহায্যে বিষয়টি উপস্থাপন করতে পারেন।

৫. শ্রেণিতে দলগত কাজের মাধ্যমে, কিংবা বিভিন্ন অ্যাসাইনমেন্টে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে একত্রে কাজ করতে দিলে তাদের মধ্যে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ায় জ্ঞানের বিকাশ ঘটে এবং বিষয়টি সহজে শিক্ষার্থীদের আয়ত্তে আসে।

একটি উদাহরণ দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করি- সমস্যাঃ তিনটি রেখা একই তলে কতভাবে অবস্থান করতে পারে?

এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর রেখা এবং বিন্দু সম্পর্কে পূর্বজ্ঞান থাকতে হবে। এই পূর্বজ্ঞানের আলোকে শিক্ষার্থীর চিন্তাকে সচল করতে হবে এভাবে যে,

১. তিনটি রেখা পরস্পরককে ছেদ করতে পারে,

২. রেখাগুলো ছেদ করবে না,

৩. রেখাগুলো সমান্তরালে থাকবে,

প্রিয় পাঠক, GulfHive এর বিভিন্ন শিখন তত্ত্বের প্রাথমিক ধারণা আর্টিকেলটি শুধুমাত্র আপনাদের রিচ টু টিচ: গণিত শিখন-শেখানো (ষষ্ঠ শ্রেণি) অনলাইন কোর্স তথ্য দেওয়ার জন্য প্রকাশিত হয়েছে। এই পোস্ট এর বিষয়ে আপনার কোনো অভিযোগ বা পরামর্শ থাকলে নিচের বাটনে ক্লিক করে কমেন্ট করুন অথবা আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন।

নিচের ভিডিওটিতে বিভিন্ন শিখন তত্ত্বের প্রাথমিক ধারণা বিষয়ক বিস্তারিত আলোচনা দেখুন

প্রশ্ন-১: ভাইগটস্কির Zone of Proximal Development তত্ত্ব বা “প্রান্তসীমা ধারণা” অনুযায়ী শিক্ষার্থীর বিকাশ কীসের উপর নির্ভর করে?

ক. জ্ঞানমূলক অবস্থার উপর,

খ. কাজের নেতিবাচক প্রতিফলনের উপর,

গ. সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার উপর,

ঘ. স্ব-শিখন দক্ষতার উপর;

প্রশ্ন-২: শিক্ষার্থীর আবেগিক বিকাশে কোন শিখন তত্ত্বের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি?

ক. সামাজিক গঠনবাদ তত্ত্ব,

খ. চিরায়ত সাপেক্ষীকরণ তত্ত্ব,

গ. জ্ঞানমূলক বিকাশ তত্ত্ব

ঘ. করন শিখন তত্ত্ব

প্রশ্ন-৩: জ্ঞানমূলক বিকাশ মতবাদ অনুসারে শিখনের তারতম্য অনুযায়ী কত বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর জীবনকে চার স্তরে ভাগ করা হয়েছে?

ক. ১ – ১৬ বছর,

খ. ১ – ১৫ বছর,

গ. ২ – ১৬ বছর,

ঘ. ২ – ১৫ বছর;

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *