স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ সৃষ্টি জঘন্যতম কাজ
ইসলামে স্বামী ও স্ত্রীর সম্পর্ককে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ সৃষ্টি জঘন্যতম কাজ হিসেবে পরিগণিত হয়। আজকে কুরআন ও হাদিসের ভাষায় স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ সৃষ্টির ভয়াবহতা নিয়ে আলোচনা করবো এবং শরিয়তের ভিত্তিতে কিভাবে এর সমাধান পাওয়া যায় তা জানার চেষ্টা করবো।
আপনি এবং আপনার পরিবারের কারও মধ্যে বিচ্ছেদ সৃষ্টির কোনো সম্ভবনা দেখলে এই বিষয়ে তাকে জানানোর চেষ্টা করুন। আল্লাহ অবশ্যই আপনাকে এর প্রতিদান দিবেন।
তারা (ফেরেশতাদের কাছে) এমন তদবীর শিখতাে যাতে তারা স্বামীস্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ ঘটাতাে।
সূরা আল বাকারাঃ ১০২
গত পর্বে আমরা পূর্ববর্তী শরিয়তেও রয়েছে সদাচারের নির্দেশনা সংক্রান্ত বিষয়ে জেনেছি। আজকে জানবো স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ সৃষ্টি জঘন্যতম কাজ এই বিষয়ে।
স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ
হযরত সােলায়মান আলাইহিস সালামের যুগের একটি ঘটনা এখানে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হয়েছে। তখন লােকদের নিকট অধিকতর চাহিদার বিষয় ছিল তাবিজ-তুমার বা যাদুর প্রভাবে অন্যের স্ত্রীকে তার থেকে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে নিজের দিকে আকৃষ্ট করা।
হারুত ও মারূত নামের দু’জন ফেরেশতাকে আল্লাহ তা’আলা পরীক্ষার জন্যে দুনিয়াতে পাঠিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তারা পরীক্ষায় টিকতে পারেনি। ঘটনাটি সংক্ষেপে এই!
একদা কতিপয় ফেরেশতা মানব জাতির আমল নিয়ে সমালােচনা করে আল্লাহকে বললাে, যেই মানব জাতিকে তােমার ইবাদাতের জন্যে সৃষ্টি করেছ, তারাই তাে তােমার নাফরমানীতে লিপ্ত।
আল্লাহ বললেন, মানুষ আমাকে দেখছে না বিধায় এমনটি করছে।
কোনাে কোনাে বর্ণনা মতে ফেরেশতাদের অভিযােগ ছিল মানুষ দুনিয়াতে ন্যায় বিচার করে না। আল্লাহ বললেন: তােমাদের মধ্য থেকে দু’জন ফেরেশতাকে আন। অধিক সদাচারী দু’জন ফেরেশতা হারুত ও মারূতকে নফসের খাহেশ দিয়ে পরীক্ষার জন্যে দুনিয়াতে পাঠানাে হলাে।
জোহরা নামী একটি অতি সুন্দরী মহিলাকে দেখে তারা ঠিক থাকতে পারলাে না। কোনাে কোনাে বর্ণনা মতে মহিলাটি হযরত হারূত ও মারূতের আদালতে তার স্বামীর বিরুদ্ধে এক মােকদ্দমা নিয়ে এসেছিল।
অবশেষে হত্যা করা, শরাব পান করা ও মূর্তিপূজা করার মধ্যে যে কোনাে একটি শর্ত পূরণ করলে ঐ মহিলা ফেরেশতাদ্বয়কে তাদের বাসনা পূরণ করতে দেবে বলে সম্মতি জানালাে।
স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ সৃষ্টি জঘন্যতম কাজ
- আরও পড়ুনঃ জান্নাতে যেমন সঙ্গী পাবেন নারী ও পুরুষ
কিন্তু আল্লাহ তাে তাদের পাঠানাের সময় ঐসব কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়ে পাঠিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত তাদের
ওয়াসওয়াসায় তারা শরাব পান করাকে অপেক্ষাকৃত কম জঘন্য মনে করে শরাব পান করলাে।
অতপর যেই একজন ফেরেশতা তার বাসনা পূরণে উদ্যত হলাে তখনি মহিলাটি বললাে, আচ্ছা তােমরা কি পড়ে আকাশে উঠে যাও তা আমাকে বলাে। তবে তােমাদের মনােবাঞ্ছা পূরণ করবাে।
তারা তাকে ওটা শিক্ষা দিল। মহিলাটি তা পড়ে আকাশে উঠে গেল। সেখানে সে অগ্নিপিণ্ডে পরিণত হয়ে স্থবীর হয়ে গেল। আজকেও জোহরা সেতারা নামে মানুষ তাকে জানে।
তাফসীরকারকদের এ ঘটনাকে অনেক মুহাক্কিক আলেম ইসরাঈলী রেওয়ায়াতের অন্তর্ভুক্ত মনে করেন।
হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী তাঁর তাফসীরে বলেছেনঃ যে এ ঘটনাটি কোনাে নির্ভরযােগ্য রেওয়ায়েত দ্বারা সমর্থিত নয়। ইবনে কাসীরের উদ্ধৃত এ ঘটনাকে তিনি আয়াতের ব্যাখ্যার ভিত্তি নয় বলে উল্লেখ করেছেন।
উপরােক্ত আয়াতে তখনকার মানুষ যে ঐ দু’জন ফেরেশতা থেকে স্বামীস্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটানাের তদবীর বা যাদু শিখতে ; তাদের নৈতিক অধঃপতনের সেই জঘন্যতম অবস্থার বর্ণনা করা হয়েছে।
ফেরেশতাদ্বয় মানুষকে স্পষ্ট ভাষায় সাবধান করে দিতাে যে, আমরা তাে পরীক্ষার জন্যে এসেছি। সুতরাং তােমরা এসব করে—নিজের পরকাল ধ্বংস করাে না। এতদসত্ত্বেও মানুষ তাদের কাছ থেকে তাবীজ-তুমার বা আমালিয়াত গ্রহণের জন্যে পাগল হয়ে গেল।
মুফতী মুহাম্মদ শফী (র) তার “তাফসীরে মাআরেফুল কুরআনে” হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর বায়ানুল কুরআনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, এক সময়ে বাবেল শহরে যাদু বিদ্যার খুব প্রচলন ছিল।
যাদুর অত্যাশ্চার্য ক্রিয়া দেখে মূর্খ লােকদের মধ্যে যাদু ও মােজেযার মধ্যে বিভ্রান্তি দেখা দেয়।
কেউ কেউ যাদুকরদের সজ্জন ও অনুসরণ যােগ্য মনে করতে থাকে, আবার কেউ কেউ যাদুকে পূন্য কাজ মনে করে তা শিখতে ও আমল করতে থাকে।
যেমন আজকাল মেমারিজমের বেলায়ও তাই হচ্ছে। এ বিভ্রান্তি দূর করার উদ্দেশ্যে আল্লাহ তা’আলা বাবেল শহরে হারুত ও মারূত দুজন ফেরেশতা পাঠান। তাদের দায়িত্ব ছিল যাদুর স্বরূপ ও ভেল্কিবাজী সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করা—
যাতে বিভ্রান্তি দূর হয় এবং মানুষ যাদুর আমল ও যাদুকরদের থেকে দূরে থাকে। নবীদের নবুওয়াতের জন্য যেমন মুজেযা দেয়া হয় তেমনি হারূত ও মারূতের ফেরেশতা হওয়ার প্রমাণ সহ তাদের পাঠানাে হলাে।
ফেরেশতাদ্বয় বাবেল শহরে তাদের কাজ শুরু করে দিলেন। তারা যাদুর মূল ও শাখা-প্রশাখা বর্ণনা করে জনগণকে এ কু-কর্ম থেকে বিরত থাকার ও যাদুকরদের ঘৃণা করার উপদেশ দিলেন।
এ সময় বিভিন্ন লােক বিভিন্ন সময়ে ফেরেশতাদের কাছে আসা-যাওয়া করতে থাকে। পরে এসব যাতায়াতকারীগণ অনুরােধ করতে থাকে যে, তাদেরকেও যাদুর মূল ও শাখা-প্রশাখা শিখিয়ে দেয়া হােক যেন তারা অজ্ঞতাবশতঃ এতে বিশ্বাসী না হয়ে পড়ে অথবা কোনাে অপকর্মে লিপ্ত হয়ে না পড়ে।
স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ সৃষ্টি জঘন্যতম কাজ
ফেরেশতাগণ তাদের অনুরােধ রক্ষা করে যাদু শিখিয়ে তাদের সাবধান করে দিতাে,
“দেখ ! আমাদের উপদেশ এই যে, তােমরা যেন যাদু বিদ্যা শিখেও সুনিয়্যাতের উপর কায়েম থাক। এমন যেন না হয় যে আত্মরক্ষার অজুহাতে আমাদের থেকে যাদু শিখে নিজেই অপকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়! আর দ্বীন ও ঈমান বরবাদ করে বসাে।
এভাবে যারা ওয়াদা অঙ্গীকার করতাে তাদের যাদুর মূল ও শাখা-প্রশাখা বলে দেয়া হতাে। অতপর কেউ কেউ ওয়াদা ভংগ করে সৃষ্টজীবের অনিষ্ট করতাে। এটা নিশ্চিতরূপেই একটি দুষ্কর্ম ছিল।
দাম্পত্য সম্পর্ক মানব সভ্যতার ভিত্তি স্বরূপ। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সুষ্ঠু ও সঠিক সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার উপরই গােটা মানব সমাজের সুষ্ঠুতা একান্তভাবে নির্ভর করে। অন্যথা পুরাে সমাজটিই চূর্ণবিচুর্ণ হতে বাধ্য।
হাদীস শরীফে আছে, ইবলীস তার কর্মকেন্দ্র থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে তার এজেন্ট প্রেরণ করে। তারা ফিরে এসে নিজ নিজ রিপাের্ট পেশ করে থাকে। কেউ বলে আমি অমুক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছি, কেউ বলে আমি অমুক অশান্তি ঘটিয়েছি, কেউ বলে আমি অমুক পাপাচার সংঘটিত করেছি।
স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ সৃষ্টি জঘন্যতম কাজ
কিন্তু তাদেরই রিপাের্টের জবাবে ইবলীস মন্তব্য করে যে,
তােমরা কিছুই তাে করনি। অবশেষে একটা এজেন্ট এসে বলে আমি একটি দম্পতির মধ্যে বিচ্ছেদ সৃষ্টি করেছি। একথা শুনে ইবলীস তার সাথে আলিংগন করে বলে, “তুমিই তাে একটা কাজের মত কাজ করেছ।”
মানুষের প্রকাশ্য শত্রু শয়তান মানব জীবন, মানব পরিবার ও মানব সভ্যতার ভিত স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক বিনষ্ট করতে পারলেই খুশী হয়। আর এ সম্পর্ক স্থাপিত হয় বিবাহের পবিত্র বন্ধন দিয়ে।
আজকের সমাজের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে পর্যালােচনা করলে ঐ সময়ের শয়তানের চরিত্রের সাথে সামঞ্জস্য দেখা যায়। সে যুগের লােকদের নৈতিক ও চারিত্রিক অধপতনের গভীরতা যেমন উক্ত অবস্থা থেকে জানা যায়, তেমনি তার সাথে তুলনা করে বর্তমান সমাজকেও মূল্যায়ন করা সহজ হয়।
আমাদের সমাজের প্রত্যেক আনাচে-কানাচে আজকে যেন হযরত সােলায়মান (আ)-এর যুগের লােকদের চারিত্রিক অধঃপতনের চূড়ান্ত রূপায়ণ ঘটছে।
স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ সৃষ্টি জঘন্যতম কাজ
কথায় কথায় তাবীয-তুমার ও যাদু-বিছট করে সামাজিক অশান্তি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।
তাবীয় করে অন্যের স্ত্রীকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করা, অন্যের কন্যাকে অবৈধভাবে নিয়ে যাওয়া আজকের নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। আর সে পথ সহজ করে দিয়েছে বেপর্দায় মহিলাদের চলাফেরা, তাদের বেপরােয়া যত্রতত্র বিচরণ, সহশিক্ষার প্রচলন ও সিনেমা টি. ভি.র অশ্লীল ছবি প্রদর্শন।
একশ্রেণীর বিকৃতমনা তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অদূরদর্শিতা ঘেরা অজ্ঞতা আমাদের সমাজের এহেন বিরূপ পরিবেশ সৃষ্টির সহায়ক ও লালনকারীর ভূমিকায় তৎপর থাকায় এ অধপতিত সমাজের বিশুদ্ধতা লাভের সম্ভাবনার বিলুপ্তি ঘটেছে।
আজকের সমাজে মানুষ যে কোনাে হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার মানসে তারই মত আরেকজন লােককে যথাযথ কারণ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত এমনকি হত্যা পর্যন্ত করে বসে।
আর গ্রামে-গঞ্জে পর্যন্ত খনার-খলীফা দিয়ে তাবীজ-তুমার করে মানুষের ক্ষতি করতে এমনকি জানে শেষ করে দিতেও কুণ্ঠাবােধ করছে সামান্য স্বার্থ হাসিলের জন্যও মানুষ মানুষকে প্রতারিত করতে এমনকি জীবনে শেষ করে দিতে এতটুকুও ইতঃস্তত করে না।-(তাফসীরে ইবনে কাসীর ও মা’আরেফুল কুরআন)
স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ সৃষ্টি জঘন্যতম কাজ