শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনা ও ব্যবস্থাপনার দক্ষতা সম্প্রসারণ
আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনা ও ব্যবস্থাপনার দক্ষতা সম্প্রসারণ; এই পাঠে শ্রেণি ব্যবস্থাপনার কৌশল সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও এখানে শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনার দক্ষতা সম্প্রসারণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
গতপর্বে আমরা জেনেছি শিক্ষকের সামাজিক আবেগিক দক্ষতার মাধ্যমে সীমাবদ্ধতা মোকাবেলার কৌশল নিয়ে। আশা করছি আপনি এটি উপভোগ করেছেন এবং এর দ্বারা উপকৃত হয়েছেন।
শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনা
যে কোন শিক্ষা ব্যবস্থার কেন্দ্রে রয়েছে শিক্ষার্থী ও তার শিখন। তাই শ্রেণিকক্ষে পরিচালিত শিখন- শেখানো কার্যাবলীতে শিক্ষার্থীর সক্রিয় অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শিক্ষক শিক্ষার্থীদের শিখনকে আকর্ষনীয়, স্থায়ী ও ফলপ্রসূ করার জন্য যে সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, তার সবই শ্রেণি ব্যবস্থাপনার অংশ। একজন শিক্ষককে শ্রেণিকক্ষে এই কাজগুলো নিয়মিত করতে হয়-
১. শিক্ষার্থীদের আসন বিন্যাস করা শ্রেণিকক্ষে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশের ব্যবস্থা করা,
২. শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি রেকর্ড করা,
৩. শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণ করা,
৪. শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রন করা,
৫. ব্ল্যাকবোর্ডের সর্বোত্তম ব্যবহার,
৬. পাঠের শুরুতেই শ্রেণি নিয়ন্ত্রন করা,
৭. পাঠের মধ্যে শ্রেণির মনোযোগ আকর্ষণ করা,
৮. শিখন সামগ্রী সংগ্রহ করা,
৯. শিক্ষা উপকরণ ব্যবহার করা,
১০. প্রশ্নোত্তর পর্বে শিক্ষার্থীদের সক্রিয় রাখা,
১১. শ্রেণি পর্যবেক্ষণ করা,
১২. শিখনে আগ্রহ সৃষ্টি করা,
১৩. শিক্ষার্থীর অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা;
শ্রেণিকক্ষে পরিচালিত শিখন-শেখানো কার্যাবলিতে অংশগ্রহণের ফলে শিক্ষার্থী কী শিখছে, কী মাত্রায় শিখছে এবং কতটা সহজ ও ভালোভাবে শিখতে পারছে অথবা তার শিখনে ঘাটতি রয়েছে কি না এবং থাকলে কতটা ঘাটতি রয়েছে সে সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়।
শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্র অনেক বড়। এখানে স্বল্প পরিসরে শ্রেণি ব্যবস্থাপনার কিছু কৌশল নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
শ্রেণি ব্যবস্থাপনার কৌশল
বছরের শুরুতেই শিক্ষক শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের অনুসরণীয় একটি চার্ট তৈরি করে তা পালনের জন্য শ্রেণিকক্ষের দেয়ালে ঝুলিয়ে দিতে পারেন।
শিখন-শেখানো কাজ পরিচালনার শুরুতেই দেয়ালে টানিয়ে দেওয়া চার্টের বিষয়ের প্রতি শিক্ষার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতে পারে। এটি শিখন-শেখানো কাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। যেমন-
ক. শিক্ষকের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনব,
খ. দলে কাজের সময় সবার মতামত শুনব,
গ. অন্যের মতের সাথে একমত না হলে ভদ্রভাবে যুক্তি দিয়ে তার মতো খণ্ডন করব,
ঘ. দলে সক্রিয় অংশগ্রহণ করব,
ঙ. কিছু বলার আগে হাত তুলব,
চ. সবার সাথে ভালো ব্যবহার করব এবং সদ্ভাব বজায় রাখব,
ছ. আমার খাতায় আমার কথা বা চিন্তা নিজেই লিখব,
জ. সবাই একসাথে কথা বলব না, একজন বলার পর অন্যজন বলব,
ঝ. সবাইকে দলের কাজ উপস্থাপন করার এবং অংশগ্রহণ করার সুযোগ দেব,
ঞ. শান্তি বজায় রাখব যাতে সবাই সবার কথা শুনতে পায়,
ট. দলের কাজ পরিচালনায় একে অন্যকে সহযোগিতা করব, ইত্যাদি।
শ্রেণিকক্ষে শিখন-শেখানো কাজ পরিচালনার সময় শিক্ষকের অবস্থান হবে শ্রেণিকক্ষের সামনের দিকে অর্থাৎ লেখার বোর্ডের কাছাকাছি।
আসন ব্যবস্থা এ-রকম রাখতে হবে যেন শিক্ষক মাঝে মাঝে ডান-বাঁয়ে ও পিছনের দিকে চলাচল করতে পারেন এবং সকল শিক্ষার্থীর কাছাকাছি যেতে পরেন।
শিক্ষককে সকল শিক্ষার্থীর প্রতি সমানভাবে লক্ষ রাখতে হবে। শিক্ষক এমন স্থানে দাড়াবেন যেন অধিকাংশ শিক্ষার্থীর সাথে ‘আই কন্ট্যাক্ট’ বা দৃষ্টি বিনিময় করা যায়।
আবার, কোন শিক্ষার্থীর দিকে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে থাকবেন না। বরং বারবার ঘুরে ঘুরে সকল শিক্ষার্থীর দিকে তাকাবেন।
শিক্ষক শ্রেণিতে কয়েকজন শ্রেণিনেতা ঠিক করে দিতে পারেন এবং শ্রেণিনেতাদের শ্রেণিকক্ষের বিভিন্ন জায়গায় বসতে উৎসাহিত করবেন।
শিখন-শেখানো কাজ পরিচালনার সময় শিক্ষক এই শ্রেণিনেতাদের সহায়তা নেবেন। এর ফলে শিক্ষক অধিক শিক্ষার্থী সংবলিত শ্রেণি সহজেই ব্যবস্থাপনা করতে পারবেন।
তবে কয়েকদিন পর পর (হতে পারে প্রতি পনের দিন পর বা প্রতি মাসে) নতুন শ্রেণিনেতা নির্বাচন করতে হবে। নতুবা একজন বেশিদিন নেতৃত্ব দিলে তার মধ্যে অহমিকা এসে যেতে পারে।
তাছাড়া অন্যরা নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। পালাক্রমে নেতৃত্ব দিলে সকল শিক্ষার্থীর মধ্যেই নেতৃত্বের গুণাবলি তথা আন্তঃব্যক্তিক বুদ্ধিমত্তা বিকশিত হবে। শিক্ষক শ্রেণিতে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর নাম জানলে এবং নাম ধরে ডাকলে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীরা উৎসাহ বোধ করে।
শ্রেণিতে দলগত কাজ দেয়ার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে দল গঠন না করে আগে থেকেই দল গঠন করে রাখা যেতে পারে। ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য শিক্ষক পারঙ্গম ও শিখন সমস্যাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে ৫/৬টি দল গঠন করবেন।
আবার কয়েকদিন পর পর দলীয় সদস্য পরিবর্তন করে নতুন দল গঠন করতে হবে। এতে সকলের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠবে এবং সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মধ্যে বেড়ে উঠবে।
শ্রেণিতে শিক্ষার্থীরা এই দল অনুযায়ী একসঙ্গে বসবে এবং প্রতি সপ্তাহে পর্যায়ক্রমে বসার জায়গা পরিবর্তন করবে। শিক্ষক দলের নাম শিক্ষার্থী উপযোগী করার জন্য নদী/ফুল/ফল/রং ইত্যাদি নামে দলের নাম রাখবেন।
এভাবে দলগতভাবে শিক্ষার্থীরা বসলে শিক্ষক খুব সহজেই দলগত কাজ করাতে পারবেন। যেমন- সামনের বেঞ্চে যারা বসে আছে তারা ঘুরে পেছনের বেঞ্চের শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি হয়ে বসবে এবং দলগত কাজে অংশগ্রহণ করবে।
মাঝে মাঝে শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের বসার জায়গা পরিবর্তন করানো, যেমন- সামনে যারা বসেছে তাদের পেছনে এবং পেছনের শিক্ষার্থীদের সামনে বসার সুযোগ দেয়া উচিত।
তবে এই কাজটি মাসে এক/দুইবার করা যেতে পারে। শ্রেণিতে বসার বেঞ্চগুলো মাঝে মধ্যে ভিন্নভাবে সাজানো যেতে পারে। এতে শিক্ষক শিখন-শেখানো কাজ চলাকালে শিক্ষার্থীদের কাছাকাছি যেতে পারবেন।
এই কাজটি অবশ্য নির্ভর করবে শ্রেণিকক্ষটির আকার-আয়তনের ও শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যার ওপরে।
শিক্ষক শ্রেণিতে যখন কোনো প্রশ্ন করবেন তখন প্রশ্নটি শ্রেণিতে উপস্থিত সকল শিক্ষার্থীর উদ্দেশ্যে করবেন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা উত্তরটি পারবে তারা হাত উঁচু করবে। শিক্ষক যেদিকে থাকবেন তার বিপরীত দিক থেকে যে সকল শিক্ষার্থী হাত তুলবে তাদের মধ্য থেকে একজনকে উত্তর দিতে বলবেন।
এমন একজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে উত্তর নিতে হবে যেন তার উত্তর সকল শিক্ষার্থী শুনতে পায়৷ এরপর শিক্ষক তার অবস্থান পরিবর্তন করবেন এবং একই পদ্ধতি অনুসরণ করে অন্য একজন শিক্ষার্থীকে উত্তর দিতে বলবেন।
এভাবে কয়েকজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে শোনার পর, যারা হাত উঁচু করেনি তাদের কাছ থেকে উত্তর শুনবেন। তবে উত্তরটি পেছনের দিকের/সারির শিক্ষার্থীদের দিতে উৎসাহিত করবেন।
শিক্ষক একজন একজন করে উত্তর দেওয়াকে উৎসাহিত করবেন। সকল শিক্ষার্থীর একসাথে উত্তর দেওয়াকে নিরুৎসাহিত করবেন।
অপেক্ষাকৃত ভালো বা তাড়াতাড়ি পাঠ প্রস্তুত করতে পারে এমন শিক্ষার্থীদের জন্য শ্রেণিকক্ষে একটি কর্নারে ছোট শেলফে কিছু শ্রেণি উপযোগী সম্পূরক পড়ার বই বা ছবি আঁকার সামগ্রী রাখা যেতে পারে।
যাদের পাঠ পূর্বেই প্রস্তুত হয়ে যাবে শিক্ষক তাদের এসব সম্পূরক পঠন সামগ্রী পড়তে দিতে পারেন বা তাকে ইচ্ছে মতো আঁকতে দিতে পারেন।
নতুবা তারা দুষ্টামিতে জড়িয়ে পড়তে পারে কিংবা মনোযোগ হারিয়ে ফেলতে পারে।
এ ধরনের অনেক কৌশল শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে ব্যবহার করতে পারেন। এখানে যেগুলো উপস্থাপন করা হয়েছে এগুলো কিছু নমুনা মাত্র। শিক্ষক সময় ও অবস্থা অনুযায়ী তার বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে শিক্ষার্থী উপোযোগী বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করতে পারেন। প্রবাদ আছে, ‘কোনো শিক্ষাদান পদ্ধতি স্বয়ং শিক্ষক অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হতে পারে না’ অথবা ‘শিক্ষকের পদ্ধতিই সেরা পদ্ধতি।
কথাগুলো একেবারে সত্য। শিক্ষক যদি শিখন-শেখানো কার্যক্রমের জন্য উপযুক্ত পদ্ধতি ও কৌশল নির্বাচনে ব্যর্থ হন, অথবা উপযুক্ত পদ্ধতি নির্বাচন করেও যথাযথভাবে প্রয়োগে ব্যর্থ হন, তাহলে শিখন- শেখানো কার্যক্রম সার্থক ও কার্যকর করা সম্ভব হবে না।
কাজেই শিক্ষক যদি পাঠদানের সকল পদ্ধতি/কৌশল এবং এর প্রয়োগকৌশল ভালোভাবে জেনে উপযুক্ত পদ্ধতি/কৌশল নির্বাচন করে তা যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে পারেন, তবে অধিক শিক্ষার্থী সংবলিত শ্রেণিকক্ষেও শিখন-শেখানো কার্যক্রমের উদ্দেশ্য অর্জন সম্ভব।
তার পূর্বে শিক্ষকের অবশ্যই বড় শ্রেণিকক্ষ কীভাবে ব্যবস্থাপনা করতে হয় সে কৌশলসমূহ সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা থাকতে হবে।
শ্রেণিকক্ষের আচরণগত বিষয় মোকাবিলার দক্ষতা
উত্তম শ্রেণিব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা অন্যতম একটি উপাদান। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীর অসঙ্গত আচরণ বা শিখন প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক গতিতে বিঘ্ন সৃষ্টি করে এমন যে কোন আচরণ শ্রেণি পরিবেশ নষ্ট করে দেয়।
ফলে শিক্ষক শ্রেণিকক্ষের শৃঙ্খলা রক্ষা করতে ব্যর্থ হন। শিক্ষকের ব্যবস্থাপনাগত এই ত্রুটি সমগ্র শ্রেণিকক্ষে, এমন কি অন্যান্য শিক্ষার্থী যারা মোটামুটি নিয়মনীতি মেনে চলে, তাদের উপরও প্রভাব বিস্তার করে।
শিক্ষার্থীর অসদাচরণ, নিয়মনীতি ভংগকারী কাজ ইত্যাদির জন্য সব ক্ষেত্রেই যে শিক্ষকের অদক্ষতা দায়ী তা নয় বরং দেশীয় সামাজিক, অর্থনৈতিক অস্থিরতাসহ বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাগুলোই
এর জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়ী। তবে, শ্রেণিকক্ষের ভিতরে সংঘটিত এবং প্রভাব বিস্তারকারী কিছু আচরণ আছে যেগুলো প্রতিরোধ করে শিক্ষক শ্রেণি পরিবেশে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারেন। শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে শ্রেণিকক্ষে অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ প্রতিরোধ করার দক্ষতাকে প্রতিরোধমূলক শৃঙ্খলা দক্ষতা বলে।
বিভিন্ন ধরনের আচরণগত সমস্যা প্রতিরোধ করে শ্রেণিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য শিক্ষক যথাযথ কৌশল প্রয়োগ করে শ্রেণিব্যবস্থাপনায় সফল হতে পারেন। সাধারণভাবে একজন শিক্ষকের যেসব প্রতিরোধমূলক শৃঙ্খলা দক্ষতার প্রয়োজন হয় সেগুলো হলঃ
এর জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়ী। তবে, শ্রেণিকক্ষের ভিতরে সংঘটিত এবং প্রভাব বিস্তারকারী কিছু আচরণ আছে যেগুলো প্রতিরোধ করে শিক্ষক শ্রেণি পরিবেশে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারেন। শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে শ্রেণিকক্ষে অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ প্রতিরোধ করার দক্ষতাকে প্রতিরোধমূলক শৃঙ্খলা দক্ষতা বলে।
বিভিন্ন ধরনের আচরণগত সমস্যা প্রতিরোধ করে শ্রেণিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য শিক্ষক যথাযথ কৌশল প্রয়োগ করে শ্রেণিব্যবস্থাপনায় সফল হতে পারেন। সাধারণভাবে একজন শিক্ষকের যেসব প্রতিরোধমূলক শৃঙ্খলা দক্ষতার প্রয়োজন হয় সেগুলো হলঃ
সংবেদনশীলতা
শ্রেণিকক্ষে সংঘটিত প্রতিটি ঘটনার প্রতি শিক্ষকের মনোযোগ স্থাপন ও মূল্যায়ন দক্ষতা অতি প্রয়োজনীয়।
যে যেমন আচরণই করুক না কেন, আচরণের প্রকৃতি, কে করেছে, পরিবেশ পরিস্থিতি, শিক্ষার্থীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, চাহিদা ইত্যাদি সবকিছুই শিক্ষকের বিবেচনায় আনতে হবে।
আচরণ নৈপূন্য
শিক্ষক শিক্ষার্থীর কাছে যে আচরণ আশা করছেন, তার কোন অংশে শিক্ষকের নিজের আচরণে ঘাটতি আছে কিনা তা নিজে লক্ষ্য করে তিনি তা শুধরে নিবেন।
যেমন, মার্জিত ভাষার ব্যবহার বা পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ৷ লক্ষণীয়, শিক্ষার্থীর সামনে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক তার কোন সহকর্মী সম্বন্ধে কটূক্তি করবেন না।
একাধিক আচরণ সমস্যার প্রতি একই সময় মনোযোগ দেওয়া
শ্রেণিকক্ষের প্রত্যেক শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্ব অনুসারে তাদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা ভিন্ন হয়, সে অনুযায়ী তাদের আচরণেও ভিন্নতা থাকে। যেমন, কেউ একজন হাই তুলল, অন্যরাও মজা পেয়ে একই রকম মুখভঙ্গি করল।
অথবা শ্রেণিকক্ষের অন্যপ্রান্তে শিক্ষার্থী অন্য কোন ধরনের অসংগত আচরণ করল কি না ইত্যাদি সব কিছুই শিক্ষক একই সাথে লক্ষ্য করবেন এবং সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করবেন।
মূলত, অংশগ্রহণমূলক শিখন ব্যবস্থায় শিক্ষার্থী সাধারণভাবে পড়ার বিষয়বস্তু ভিন্ন অন্য কোন ব্যাপারে মনোযোগী হওয়ার সুযোগ পায় না।
প্রতিটি ঘটনার প্রতি শিক্ষকের সজাগ দৃষ্টি
শ্রেণিকক্ষের ভিতরে শিখনের প্রতিটি স্তর এবং অন্য যে কোন ঘটনার প্রতিটি ধাপের প্রতি শিক্ষকের সজাগ দৃষ্টি থাকবে। কেননা, কোথায় বা কোন পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছে শিক্ষক তা অতি দ্রুততার সাথে স্পষ্ট করবেন।
কাজের গতি অক্ষুন্ন রাখা
শিক্ষক যদি পরিকল্পনা করেন এবং ধারাবাহিকতা রক্ষা করেন তবে কাজের গতি অক্ষুন্ন থাকে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মনোযোগ ধরে রাখা এবং নির্দিষ্ট সময়ের সবটুকু যথার্থভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হয়।
এমন কি শিক্ষার্থীর কোন আচরণগত ত্রুটি মোকাবিলা করার জন্য যে সময় ব্যয় হয়েছে, সেটি সামলে নিয়েও শিক্ষক সামগ্রিকভাবে তার কাজের গতি রক্ষা করতে পারেন।
শ্রেণিকক্ষের নানাধরণের কাজের মধ্যে ধারাবাহিকতা রাখা
ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য সময়, শিখন সামগ্রী, উপকরণ, তথ্য ইত্যাদি সব কিছুর সুষম বিন্যাস প্রয়োজন এবং সেগুলো হাতের কাছে রাখা দরকার।
সেই সাথে শিখন ছাড়াও শিক্ষার্থীর আচরণ সমস্যা বা অন্যান্য বিষয় সংক্রান্ত কোন কাজের মূল ব্যবস্থাপনায় যেন ছন্দপতন না হয় শিক্ষক সেদিকে লক্ষ্য রাখবেন।
মোটকথা, শিক্ষার্থীকে অমনোযোগী হওয়ার সুযোগ দেওয়া যাবে না বরং মনযোগী হওয়ার পরিবেশ ধরে রাখতে হবে।
শিক্ষার্থীর অসঙ্গত আচরণ এবং তার প্রতিকার
সাধারণভাবে আমরা শিক্ষার্থীর কোন অসঙ্গত বা অসদাচরনের জন্য তাকে শাস্তি দেওয়াই যুক্তিসম্মত বলে মনে করি, কিন্তু মনে রাখতে হবে অবাঞ্ছিত আচরণ দূর করার শেষ চেষ্টা হল শাস্তিদান।
শুধু তখনই শাস্তি দেওয়া যায়, যখন অনেক রকম কৌশল প্রয়োগ করেও শিক্ষার্থীকে প্রতিহত করা যায় না। সুতরাং শাস্তি দেওয়ার আগে-
ক. শিক্ষার্থীর আচরণকে উপেক্ষা করার ভান করা যেতে পারে বরং এ সময় অন্য শিক্ষার্থীর প্রশংসনীয় কাজকে সমর্থন করা উচিত।
খ. নিয়ম ভংগকারী কোন শিক্ষার্থীকে শিক্ষক পছন্দ করেন না এটা যেন শ্রেণির সকল শিক্ষার্থী বুঝতে পারে। তাহলে দেখা যাবে অনেকেই নিয়মভংগকারী শিক্ষার্থীকে সাময়িকভাবে দল হতে বর্জন করবে। শিক্ষার্থীরা নিজেরাই নিয়ম মানতে উৎসাহিত হবে এবং অন্য কাউকে নিয়ম ভাঙতে নিরুৎসাহিত করবে।
গ. শিক্ষকের আলোচিত বিষয়বস্তুতে শিক্ষককে স্থির থাকতে হবে।
ঘ. কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর সংশোধনের জন্য সময় লাগে। ধৈর্য্য হারানো যাবে না। তবে শিক্ষার্থীর অন্যায় আচরণকে এক মুহুর্তের জন্যও আমল দেওয়া যাবে না ৷
দীর্ঘ সময় ধরে এ ধরনের কৌশল প্রয়োগের পরেও যদি শিক্ষার্থীর মধ্যে কোন পরিবর্তন না আসে, তবে তাকে শাস্তি দেওয়া যেতে পারে।
কিন্তু শাস্তি দেওয়ার আগে শিক্ষকের ভাবতে হবে,
১. শাস্তির ফলাফল কী হবে?
২. শিক্ষার্থীর আদৌ কোন ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে কি না?
৩. তার শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না?
৪. অন্যান্য শিক্ষার্থীর মধ্যে এর কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে?
এসব কিছু ভেবে নিয়ে শিক্ষক যদি দেখেন, শ্রেণি শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য এবং শিখন পরিবেশ বজায় রাখার জন্য শাস্তি দেওয়া জরুরী,
তখন শিক্ষার্থীর অপরাধের মাত্রার উপর নির্ভর করে কিছু শাস্তি দিতে পারেন। যেমন –
ক. মৃদু তিরস্কার,
খ. কঠোরভাবে তিরস্কার,
গ. তার কাজে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন,
ঘ. শ্রেণি থেকে তাকে সাময়িকভাবে বর্জন,
ঙ. শ্রেণির বাইরে রাখা,
চ. শ্রেণির পাঠের আনন্দ থেকে বঞ্চিত করা,
ছ. মাসিক পরীক্ষায় মোট নম্বর থেকে ১/২ নম্বর কমিয়ে দেওয়া,
তবে শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে শিক্ষককে অবশ্যই শিক্ষার্থীদের প্রতি সংবেদনশীল হতে হবে। শাস্তির প্রভাব যাতে নেতিবাচক না হয় সেদিকে শিক্ষকের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
মনে রাখা দরকার, প্রত্যেক শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্ব এবং সংবেদনশীলতার মাত্রা ভিন্ন, তাই শিক্ষককেও সে ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে।
একইসাথে, শাস্তি যাতে শিক্ষার্থীর জন্য সরাসরি অপমানসূচক বা ব্যক্তি আক্রমণাত্মক না হয় কিংবা তা যাতে শিক্ষার্থীর আত্মবিশ্বাসের প্রতি আঘাত না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।
শিক্ষককে মাথায় রাখতে হবে, শাস্তি প্রদানের উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীকে তার ভুল আচরণ সংশোধনের সুযোগ করে দেওয়া, অর্থাৎ তার মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসা; কখনোই তা যাতে শিক্ষার্থীকে নেতিবাচক পরিবর্তনের দিকে ঠেলে না দেয়।
শিক্ষাবছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের চাহিদার প্রেক্ষিতে শিক্ষক যদি শ্রেণি শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করেন তবে সারা বছর ভাল ফল পাওয়া সম্ভব। যেমনঃ
শিক্ষানীতি
শিক্ষানীতি স্থির করতে হবে; শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা করেই এটি করা যেতে পারে। নিয়ম ভংগ করলে কী হবে অর্থাৎ কী শাস্তি বা ফলাফল শিক্ষার্থীকে ভোগ করতে হবে সেটিও তার কাছে স্পষ্ট হওয়া দরকার।
নিয়মনীতি ও শিক্ষকের প্রতি আস্থাবান করে তোলা
শিক্ষক এবং বিদ্যালয়ের পরিবেশ শিক্ষার্থীর কাছে কী ধরনের আচরণ প্রত্যাশা করে তা তার কাছে স্পষ্ট হতে হবে। শুধু তাই নয়, নিয়মনীতির এই প্রয়োগ যেন প্রহসন না হয়ে যায়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
অর্থাৎ নিয়ম যেন স্থান, কাল, পাত্র ভেদে ভিন্ন না হয়। শিক্ষার্থীকে নিয়মনীতি ও শিক্ষকের প্রতি আস্থাবান করে তোলা জরুরী এবং এই দায়িত্ব শিক্ষককেই পালন করতে হবে।
শিক্ষার্থীর চাহিদা এবং সমস্যা
শিক্ষক শিক্ষার্থীর চাহিদা এবং সমস্যা হতে কোন সময়ই বিচ্ছিন্ন হয়ে পরবেন না। বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সর্বক্ষণ শিক্ষার্থীর খোঁজখবর নিতে হবে। শিক্ষার্থী যেন শিক্ষককে লজ্জা বা ভয় পেয়ে সরে না থাকে তা শিক্ষককেই নিশ্চিত করতে হবে।
ছাত্র/ছাত্রীদের শৃঙ্খল করে তোলা
শিক্ষার্থীর প্রতিটি কাজের তদারকী করতে হবে। কাজের কোন স্তরে সে যেন নির্দেশোনার অভাবে গতি হারিয়ে না ফেলে। এভাবে প্রতি মূহুর্তে শিক্ষার্থীর সাথে যোগাযোগ রাখলে সে শিক্ষকের প্রতি নির্ভরশীল ও শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠে।
ফলে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের উপস্থিতিতে অসঙ্গত কোন আচরণের কথা সে ভাবতেই পারবে না। প্রতিদিনের অভ্যাসে ধীরে ধীরে শৃঙ্খলা অনুসরণ করে চলা হয়ে উঠবে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
আই কন্টাক্ট করা
শিক্ষার্থীকে নির্দেশনা দেওয়ার সময় তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে হবে। শিক্ষার্থীও শিক্ষককে কিছু বলার ক্ষেত্রে চোখের দিকে তাকিয়ে বলবে এটি নিশ্চিত করতে হবে।
ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষক কোন অন্যায় কাজ করবেন না। যেমন পক্ষপাতিত্ব, দেরী করে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করা ইত্যাদি।
শিক্ষার্থী অনেক সময় ভুল করে অন্যায় আচরণ করে ফেলে এবং পরে নিজেই অনুতপ্ত হয়৷ ব্যক্তিগত উদ্যোগে তা শুধরে নেয়ার পরামর্শ দেওয়া এবং কীভাবে সে তা করতে পারে সে ব্যাপারে নির্দেশনা প্রদান করা শিক্ষকের দায়িত্ব।
শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনায় আলোচিত বিষয়গুলো যদি শিক্ষকগণ নিজ নিজ শ্রেণিতে ধীরে ধীরে অনুশীলন করেন তাহলে নিশ্চিতভাবেই তারা শ্রেণি ব্যবস্থাপনায় আরও দক্ষ হয়ে উঠবেন এবং শ্রেণিকক্ষে উপযুক্ত শিখন পরিবেশ গঠন করতে সক্ষম হবেন।
প্রিয় পাঠক, GulfHive এর শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনা ও ব্যবস্থাপনার দক্ষতা সম্প্রসারণ আর্টিকেলটি শুধুমাত্র আপনাদের রিচ টু টিচ: গণিত শিখন-শেখানো (ষষ্ঠ শ্রেণি) অনলাইন কোর্স তথ্য দেওয়ার জন্য প্রকাশিত হয়েছে। এই পোস্ট এর বিষয়ে আপনার কোনো অভিযোগ বা পরামর্শ থাকলে নিচের বাটনে ক্লিক করে কমেন্ট করুন অথবা আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন। আপনি চাইলে ফেসবুকে আমাদের সাথে কানেক্ট থাকতে পারেন।
নিচের ভিডিওতে শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনা ও ব্যবস্থাপনার দক্ষতা সম্প্রসারণ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-
প্রশ্ন-১: শিক্ষকতায় কোন পদ্ধতিই সেরা?
- শিক্ষকের নিজের পদ্ধতি
- শিক্ষার্থীদের পছন্দের পদ্ধতি
- অভিভাবকদের পদ্ধতি
- বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি
প্রশ্ন-২: নিচের কোন কাজটি শ্রেণিকক্ষে শিখন শেখানো কাজে সহায়ক ভূমিকা হিসেবে পালন করতে পারে?
- শিক্ষার্থীদের কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা
- সব সময় পরীক্ষা নেওয়া
- শিক্ষার্থীদের অনুসরণীয় চার্ট শ্রেণিকক্ষে রাখা
- শিক্ষার্থীদের শাস্তি দেওয়া
প্রশ্ন-৩: শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের অবস্থান কোথায় হবে?
- শ্রেণিকক্ষের মাঝামাঝি
- শ্রেণিকক্ষের পিছনে
- ভাল শিক্ষার্থীদের মাঝে
- সকলের সাথে “আই কন্ট্যাক্ট” রাখা যায় এমন স্থানে