শিক্ষকের সামাজিক আবেগিক দক্ষতার মাধ্যমে সীমাবদ্ধতা মোকাবেলার কৌশল
চলুন জেনে নিই শিক্ষকের সামাজিক আবেগিক দক্ষতার মাধ্যমে সীমাবদ্ধতা মোকাবেলার কৌশলগুলো। একজন গণিত শিক্ষক কী কী সামাজিক ও আবেগিক দক্ষতা কাজে লাগিয়ে শ্রেণিকক্ষের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা মোকাবেলা করতে পারেন সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে এই আর্টিকেল এর মাধ্যমে।
গতপর্বে আলোচনা করা হয়েছিল গণিতের সমস্যা ছবির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপন কৌশল; তার ধারাবাকিতায় আজকে শিক্ষকের সামাজিক আবেগিক দক্ষতার মাধ্যমে সীমাবদ্ধতা মোকাবেলার কৌশল জানার চেষ্টা করবো।
শিক্ষকের সামাজিক আবেগিক দক্ষতা
সামাজিক ও আবেগিক দক্ষতা শ্রেণিকক্ষে অংশগ্রহনমূলক পদ্ধতি ও কৌশল ব্যবহারে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত। অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতি ও কৌশল ব্যবহার করে পাঠদান করলে শিক্ষার্থীর শিখন ভাল হয়৷
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একজন শিক্ষককে শ্রেণিকক্ষে যে সব সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হতে হয়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ
ক. অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থী
খ. শ্রেণির আসন ব্যবস্থা অনুকূলে না থাকা
গ. পিরিয়ডের ব্যাপ্তি কম থাকা
ঘ. শ্রেণিকক্ষের আকার আকৃতিগত সমস্যা
ঙ. শিক্ষকের দক্ষতার অভাব
চ. শ্রেণিকক্ষে প্রয়োজনীয় আসবাব ও সরঞ্জামাদির ঘাটতি
এই সব সমস্যাকে মেনে নিয়েই শিক্ষার্থীর শিখন-শেখানো কার্যক্রমকে দৃঢ় করতে একজন শিক্ষকের সামাজিক ও আবেগিক দক্ষতা প্রধান নিয়ামক বলে বিবেচিত।
শ্রেণিকক্ষে ব্যবহার উপযোগী অংশগ্রহনমূলক পদ্ধতি প্রয়োগের কৌশল হিসেবে সামাজিক ও আবেগিক দক্ষতার আলোকে একজন শিক্ষক নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর উপর দৃষ্টি দিতে পারেন-
নেতৃত্ব
শিক্ষক হিসেবে নেতৃত্বের দক্ষতার ক্ষেত্র অনেক বড় ও বিস্তৃত। স্বাভাবিকভাবে, একজন শিক্ষককে শ্রেণিকক্ষের ভিতরে এবং বাইরে অনেক ধরনের কাজ করতে হয়।
যেখানে অনেক ক্ষেত্রেই তাকে নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গি ধারন করতে হয়। নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা বিবেচনা করে শ্রেণিকক্ষে একজন শিক্ষকের দৃষ্টিভঙ্গি হতে হবে ইতিবাচক।
সময়ানুবর্তিতার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ জাগিয়ে তুলতে হলে শিক্ষকের নিজেকেও শৃঙ্খলার চর্চা করতে হবে।
একইসাথে শ্রেণিকক্ষের বিভিন্ন কাজে শিক্ষার্থীদেরকে নিয়োজিত রেখে সফলভাবে সম্পন্ন করতে পারাটাও নেতা হিসেবে শিক্ষকের সফলতা বলে বিবেচিত হতে পারে।
যোগাযোগ
অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতি ও কৌশল ব্যবহারে যোগাযোগ দক্ষতার গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ সঠিকভাবে যোগাযোগ করতে না পারলে শিখনফল অর্জন সম্ভব নয়। প্রমিত ও স্পষ্ট উচ্চারণে কথা বলতে হবে।
দৃষ্টি বিন্যাস কার্যকর যোগাযোগের সহায়ক। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে না থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী পায়চারী করতে হবে। শিক্ষার্থীদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে তারপর নিজে বলতে হবে বা উত্তর দিতে হবে।
সতীর্থ শিখনের অনুমোদন
শিক্ষার্থীদেরকে পরস্পর সহযোগিতা করার সুযোগ দিতে হবে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরস্পরকে সাহায্যে করার দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে।
শিক্ষার্থীরা যদি তাদের জ্ঞান ও দক্ষতা প্রদর্শনের সুযোগ পায় এবং সতীর্থকে বুঝাতে সক্ষম হয় তাহলে নিজেরা অনুপ্রাণিত, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ও উৎসাহী হয়৷
শিক্ষার্থীর শেখার ধরন অনুধাবন
শ্রেণির সকল শিক্ষার্থী একভাবে শেখে না। কেউ শেখে দেখে, কেউ শেখে শুনে আবার কেউ শেখে কাজ করার মধ্যমে। সুতরাং একজন শিক্ষককে শিক্ষার্থীর শেখার এই ধরন সম্পর্কে জানা থাকতে হবে।
শিক্ষকের পাঠদান এমন হওয়া উচিত যাতে সব ধরনের শিক্ষার্থীই শেখার সমান সুযোগ পায় ।
ধৈর্যশীল হওয়া
বিভিন্ন শিক্ষার্থী ভিন্ন প্রেক্ষাপটে বিভিন্নভাবে শেখে। যদি কোন শিক্ষার্থী শিক্ষকের দেওয়া পদ্ধতি অনুসরণ না করে ভিন্নভাবে শিখতে পারে, তার জন্য সে সুযোগ নিশ্চিত করাও শিক্ষকের দায়িত্ব।
সেজন্য অধৈর্য্য হওয়া উচিত নয়। এরূপ পরিস্থিতিতে ধৈর্য্যশীল হতে পারার দক্ষতা একজন শিক্ষকের জন্য অত্যাবশ্যকীয়;
সমস্যাগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের সাহায্য করা
কিছু আচরণ বা কাজ নির্দেশ করে যে শিক্ষার্থী সমস্যাগ্রস্ত। যেমন-
ক. শিক্ষার্থীর পরীক্ষায় খারাপ করা,
খ. শ্রেণিকক্ষে অতিমাত্রায় অনুপস্থিতি,
গ. শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীর বিষণ্ণ মেজাজ,
ঘ. ক্ষতিকর আবেগিক প্রতিক্রিয়া,
ঙ. হঠাৎ করে উৎসাহ কমে যাওয়া,
চ. খুব বিভ্রান্তিকর আচরণ প্রদর্শন ইত্যাদি।
এই ধরনের আচরণ দেখে একজন সমস্যাগ্রস্ত শিক্ষার্থী শনাক্ত করতে পারার দক্ষতা একজন শিক্ষকের থাকতে হবে। সমস্যাগ্রস্ত শিক্ষার্থী চিহ্নিত করার পর শিক্ষক তাকে সহায়তা করতে পারেন। সহায়তার ধরন হতে পারে-
ক. শিক্ষার্থীর সাথে একান্তে কথা বলা,
খ. শিক্ষার্থীর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা,
গ. খুব শান্তভাবে ও ধৈর্য্যের সাথে কথা শোনা,
ঘ. সমস্যা বুঝে সমাধানের চেষ্টা করা,
ঙ. শিক্ষার্থীর সাথে সহযোগিতামূলক আচরণ করা,
চ. অভিভাবকের সাথে যোগাযোগ করা;
প্রচেষ্টা ও ভুল সংশোধনের মাধ্যমে শিখনকে উৎসাহিত করা
শিক্ষার্থী যাতে তার ভুলের মধ্যমে শিখতে পারে, শ্রেণিতে সেরকম পরিবেশ তৈরী করা শিক্ষকের কাজ ও দক্ষতা। শিক্ষার্থী প্রথম পদক্ষেপেই সবকিছু শিখতে পারবে এমন আশা করা উচিত নয়। যতক্ষন পর্যন্ত সমস্যার সমাধান করতে পারবে না ততক্ষণ পর্যন্ত শিক্ষার্থীকে উৎসাহিত করতে হবে।
একীভূতকরণ
আমরা অনেক সময় নিজের অজান্তেই বা অনিচ্ছাকৃতভাবেই যারা সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে ভিন্ন তাদের দিকে সাড়া প্রদান করি না। শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক বা অন্য কোনভাবে পিছিয়ে পড়া বা যে কোন ধরনের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদেরকে এড়িয়ে গেলে বা পর্যাপ্ত দৃষ্টি না দিলে সেটি কখনও অংশগ্রহণমূলক হবে না।
এমনকি লিঙ্গ বৈষম্যও যেন না হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। কাজেই শ্রেণির সকল শিক্ষার্থীর প্রতিই সমান দৃষ্টি দিতে হবে। বাস্তবতা হচ্ছে, প্রত্যেক শিক্ষার্থীই আলাদা, প্রত্যেকেরই নিজস্ব পটভূমি আলাদা, ব্যক্তিত্ব আলাদা।
কাজেই শ্রেণিতে কাউকেই এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। সামগ্রিক পদ্ধতিতে পাঠ পরিচালনার মাধ্যমে শিখনফল অর্জন করতে হবে।
পরিবীক্ষণ
অংশগ্রহনমূলক কাজগুলো শিক্ষার্থী সঠিকভাবে করতে পারছে কি না বা করলেও কতটা করতে পারছে সেই বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। যদি কোন কারণে শিক্ষার্থী পিছিয়ে পরে তাহলে সহযোগিতার মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে এগিয়ে নিতে হবে।
সময় ব্যবস্থাপনা
প্রতিটি কাজের জন্য আলাদা করে সময় বরাদ্দ রাখতে হবে এবং সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই সেই কাজটি শেষ করতে হবে। প্রতিটি কাজের জন্যই শিক্ষার্থীকে পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে।
সুস্পষ্ট নির্দেশনা
শ্রেণিতে যে কোন ধরনের কাজ করার জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি শ্রেণি কার্যক্রমকে অনেক বেশি গতিশীল করে। সহজে অনুসরণযোগ্য নির্দেশনা থেকে সকল শিক্ষার্থী উপকার পায়।
সুস্পষ্ট নির্দেশনা শ্রেণির পিছিয়ে পরা শিক্ষার্থী এবং একই সাথে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীর জন্য অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ।
শিক্ষক শ্রেণিতে যে নির্দেশনা প্রদান করেন তা অনেক সময় সবার বোধগম্য নাও হতে পারে। তাই শিক্ষকের উচিত নির্দেশনা সবাই বুঝতে পেরেছে কি না সেটি যাচাই করে দেখা।
এই যাচাই নিৰ্দেশনা সংশ্লিষ্ট প্রশ্ন করেও করা যেতে পারে আবার শ্রেণিকক্ষের বিভিন্ন দিকে শিক্ষার্থীদের কাছে গিয়ে তাদের কাছ থেকে জানা যেতে পারে।
আবার শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রশ্ন আহ্ববান করেও নিশ্চিত হওয়া যেতে পারে তারা নির্দেশনাটি বুঝতে পেরেছে কি না। এক্ষেত্রে নির্দেশনার ব্যাপারে কিছু মাথায় রাখা দরকার।
নির্দেশনার সুস্পষ্টতায় অন্তর্ভুক্ত বিষয়সমূহ হল
১. নির্দেশনা প্রদানের পূর্বে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণ করা
২. সংক্ষিপ্ত বাক্যে অথবা ছোট ছোট অংশে ভাগ করে নির্দেশনা প্রদান করা
৩. ক্রমবাচক শব্দ ব্যবহার করে নির্দেশনা প্রদান করা। যেমন- প্রথমত, দ্বিতীয়ত, তৃতীয়ত ইত্যাদি
৪. নির্দেশনা ব্যাখ্যা করার সময় সংশ্লিষ্ট উদাহরণ ব্যবহার করা
৫. শিক্ষার্থীরা নির্দেশনা বুঝেছে কি না তা জানার জন্য প্রশ্ন করা
৬. শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের যথাযথ উত্তর প্রদান করা
৭. যে অংশটুকু শিক্ষার্থীদের বুঝতে অসুবিধা হয় তা পুনরায় বলা
৮. কিছু অংশ ব্যাখ্যা করার পর চিন্তা করার জন্য একটু সময় দেওয়া
৯. নির্দেশনায় ধারাবাহিকতা বজায় রাখা;
আলোচিত বিষয়গুলো আয়ত্ত করতে পারার উপর শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের সফলতা এবং শিক্ষার্থীদের কাঙ্ক্ষিত শিখনফল অর্জন অনেকাংশে নির্ভরশীল। এই বিষয়গুলো মাথায় রেখে শিক্ষক তার দক্ষতা বৃদ্ধির অনুশীলন করতে পারেন।
নিচের ভিডিওতে শিক্ষকের সামাজিক আবেগিক দক্ষতার মাধ্যমে সীমাবদ্ধতা মোকাবেলার কৌশলগুলো জেনে নিন
প্রিয় পাঠক, GulfHive এর শিক্ষকের সামাজিক আবেগিক দক্ষতার মাধ্যমে সীমাবদ্ধতা মোকাবেলার কৌশল আর্টিকেলটি শুধুমাত্র আপনাদের রিচ টু টিচ: গণিত শিখন-শেখানো (ষষ্ঠ শ্রেণি) অনলাইন কোর্স তথ্য দেওয়ার জন্য প্রকাশিত হয়েছে। এই পোস্ট এর বিষয়ে আপনার কোনো অভিযোগ বা পরামর্শ থাকলে নিচের বাটনে ক্লিক করে কমেন্ট করুন অথবা আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন। আপনি চাইলে ফেসবুকে আমাদের সাথে কানেক্ট থাকতে পারেন।
প্রশ্ন-১: সুস্পষ্ট নির্দেশনা মূলত কাদের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ?
১. পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীর জন্য,
২. ভাল শিক্ষার্থীর জন্য,
৩. বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীর জন্য,
৪. দুর্বল শিক্ষার্থীর জন্য;
ক. (i), (iii) ও (iv), খ. (i) ও (iii), গ. (ii), (iii) ও (iv), ঘ. সবগুলোই
প্রশ্ন-২: নিচের কোন কাজটি কার্যকর যোগাযোগে সহায়ক?
ক. পিছনে তাকানো,
খ. দৃষ্টি বিন্যাস,
গ. সমস্যা সমাধান করা,
ঘ. প্রশ্ন করা;
প্রশ্ন-৩: শিক্ষকের কোন দক্ষতা শ্রেণিকক্ষে অংশগ্রহণমূলক কৌশল প্রয়োগে সহায়ক বলে বিবেচিত?
ক. প্রশাসনিক দক্ষতা,
খ. সামাজিক ও আবেগিক দক্ষতা,
গ. শিক্ষকের বিষয়জ্ঞান,
ঘ. সময়ানুবর্তিতা;