Sign In

দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার মূলনীতি

দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার মূলনীতি

প্রিয় পাঠক, চলুন আজকে জেনে নিই দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার মূলনীতিগুলো। এই বিষয়ে আলোচনা করেছেন মাওলানা দেলাওয়ার হােসাইন সাঈদী। আমরা আপনার জন্য উনার গবেষণালব্ধ উপায়গুলো সরাসরি তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

আশা করবো যারা দুর্নীতিমুক্ত সমাজ দেখতে চান বা একটি সুন্দর ও বাসযোগ্য সমাজ তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছেন তাদের উপাকারে আসবে।

দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার মূলনীতি

বর্তমান সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘােষণা করেছেন। এ জিহাদে সফলতা অর্জনের জন্য যৌথবাহিনী, গােয়েন্দা বিভাগ, টাস্কফোর্স, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য অনেকগুলাে সংস্থা রাত-দিন পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। প্রশ্ন উঠেছে, বিগত ছয় মাসে দুর্নীতির বিরুদ্ধে পরিচালিত জিহাদের সফলতা কতটুকু?

জবাবে কেউ বলতে পারেন ৩৬ বছরের জমে ওঠা জঞ্জাল মাত্র ছয়মাসে পরিচ্ছন্ন করা কিভাবে সম্ভব? ছয় বছরেও সম্ভব নয়। কারণ সমাজ ও রাষ্ট্রের এমন কোনাে ছিদ্র নেই যে পথে এই দুর্নীতি নামক ‘ইদুর’ প্রবেশ করেনি।

নার্সারী, কেজি, প্রাইমারী, মক্তব, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়, এনজিও, হাসপাতাল, ধর্মীয় উপাসনালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটি, শিল্প-কলকারখানা, কোর্ট, কাছারী তথা মুরগীর ফার্ম থেকে শুরু করে দেশের সর্বোচ্চ সম্মানজনক ভবন পর্যন্ত দুর্নীতির রাজত্ব বিস্তৃত।

দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার মূলনীতি

দুর্নীতি নামক দূরারােগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত আজ গােটা দেশ। শুধু হুমকী-ধমকী, মামলা-মােকদ্দমা বা জেল-জরিমানায় এ মারাত্মক ব্যধি থেকে সমাজদেহ, সাময়িক নিরাময় লাভ করেছে বলে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে সমাজ দেহের রক্ত কণিকা ক্যান্সার মুক্ত নয়।

সুযােগ পেলেই এ ব্যধি গােটা রাষ্ট্রযন্ত্রকে মরণ দুয়ারের কাছাকাছি পৌছে দিবে। কারণ দুর্নীতি নামক ক্যান্সারে সমাজ নামকদেহ এতটা আক্রান্ত যে, ক্যামােথেরাপী গ্রহণের শক্তিও তার বিলুপ্তির পথে।

তবে অপরাধ আর দুর্নীতির করাল গ্রাসে শুধু যে বাংলাদেশ আক্রান্ত তা কিন্তু নয়। আমরা যেসব দেশগুলােকে সভ্য দেশ বলে আখ্যায়িত করি তারাও কিন্তু আমাদের থেকে কম যায় না।

দরিদ্র দেশ বলে আমাদের ছিন্ন বসনের কারণে শরীরের দোষ-ত্রুটিসমূহ দৃশ্যমান হয়ে পড়ে বেশী- এই যা। নতুবা আমেরিকা, ইউরােপ, আফ্রিকা, অষ্ট্রেলিয়া, এশিয়ার কয়টি দেশ এমনটি পাওয়া যাবে- যা দুর্নীতি ও অপরাধ প্রবণতা থেকে শতভাগ মুক্ত? শুধু একটি দৃষ্টান্ত দেখুন, গত কয়েক বছর পূর্বে নিউইয়র্ক শহরে রাতে কয়েক ঘন্টার জন্য বিদ্যুৎ ছিল না।

দুনিয়া জানে, মাত্র কয়েক ঘন্টার অন্ধকারের সুযােগে পৃথিবীর এই বৃহত্তম শহরে চুরি-ডাকাতী, হত্যা-ধর্ষনসহ অসংখ্য অপরাধ সংঘটিত হয়েছিলাে। এ রকম অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে যা রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি মাত্রেরই জানা আছে।

দুর্ভাগ্য এখানে যে, আমাদের দোষসমূহের যেমন ঢাক-ঢােল পেটানাে হয়- গুণ-বৈশিষ্টসমূহের তেমন প্রচার আদৌ হয় না। যেমন একটি দৃষ্টান্ত এখানে উল্লেখ করতে চাই, জাতিসংঘ একবার বিশ্বব্যাপী একটি জরিপ চালিয়েছিলাে। সবথেকে কম দুর্নীতি পরায়ণ দেশ কোনটি?

দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার মূলনীতি

সে জরীপে জানা গেলাে, সারা বিশ্বের মধ্যে সাউদী আরবেই দুর্নীতি ও অপরাধ সবথেকে কম। আমেরিকার ৫২টি রাজ্যের শুধু নিউইয়র্ক শহরে ২৪ ঘন্টায় যে চুরি-ডাকাতী, হত্যা-ধর্ষনসহ নানা প্রকারের অপরাধ ও দুর্নীতি সংঘটিত হয়, সাউদী আরবে সারা বছরেও তা হয় না।

কারণ সেখানে রাজতন্ত্র থাকলেও দেশ পরিচালনার বহুল ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান কার্যকর রয়েছে। কাজেই অপরাধ ও দুর্নীতি মুক্ত সমাজ গঠন এটি খুব সহজ বিষয় নয়। এর জন্য প্রয়ােজন একটি উত্তম মডেল। এ রকম অনুসরণীয় একটি মডেল উত্থাপন করাই আমার আজকের আয়ােজন।

দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার মূলনীতি

পাঠকদের আমি ইতিহাসের ১৪শত বছর পূর্বের একটি চিত্র দেখাতে চাই। যে সময়টাকে আমরা অন্ধকার যুগ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন যুগ বলে আখ্যায়িত করে থাকি। যেখানে মানুষ চুরি-ডাকাতী, জেনা-ব্যভিচার, হত্যা-ধর্ষন, মিথ্যা-প্রতারণা, হিংসা-বিদ্বেষ কোনােটিকেই পাপ বা অপকর্ম মনে করতাে না। সমস্ত অবৈধ কাজগুলােই ছিলাে তাদের কাছে বৈধ।

এ রকম একটি পরিবেশে মহান আল্লাহ তায়ালা সেই সমাজে প্রেরণ করলেন সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহান নেতা মহানবী বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে।

তিনি আল্লাহ প্রদত্ত ওহীর জ্ঞান ও নিজস্ব উত্তম চরিত্র মাধুর্য দিয়ে গােটা সমাজের চিত্র বদলে দিলেন। মাত্র একটি যুগের সাধনায় সহস্র বছরের মসীলিপ্ত ইতিহাস পরিণত হলাে স্বর্ণালী ইতিহাসে।

সমাজে যারা ছিলাে চোর-ডাকাত, দুর্নীতিবাজতারা হলেন মানুষের সম্পদের পাহারাদার। যারা ছিলাে নারীর সতীত্ব হরণকারী ও হন্তারক, তারা হয়ে গেলেন মানুষের জীবন ও নারীর সতীত্বের সংরক্ষণকারী।

মরু বেদুঈন রাখালরা হয়ে গেলেন ন্যায় বিচারক, খলীফা, বিচারপতি, সেনাপতি আরাে কত কি। তদানীন্তন সমাজের অধিবাসীদের এ ছিলাে চারিত্রিক জীবনে এক মহাবিপ্লব। যে বিপ্লবের মহানায়ক ছিলেন আল্লাহর প্রিয় রাসূল মানবকুল শ্রেষ্ঠ বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (সাঃ)।

তাঁর হাতে ছিলাে না কোনাে যাদুর কাঠি। ছিলাে আল্লাহর বাণী আল কোরআন- যার পবিত্র ছোঁয়ায় মৃতপ্রায় জাতি লাভ করলাে পুনর্জীবন, চীর অবহেলিত নারীরা পেলেন- বেঁচে থাকার সম্মানজনক অধিকার, শ্রমিক, শিশু, সাদা-কালাে, ধর্ম-বর্ণ সকল শ্রেণীর মানুষরা পেলাে খাদ্য-বস্ত্র, শিক্ষা-চিকিৎসা ও আবাসনসহ রাতের আঁধারে দরজা খুলে নিরপাদে ঘুমাবার নিশ্চয়তা।

নবী করীম (সাঃ) তদানীন্তন সমাজের লােকদের এ কথা বােঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, এই দুনিয়ার জীবনটাই শেষ কথা নয়, আমাদের প্রত্যেকের জন্য নির্ধারিত জীবনের মেয়াদ শেষ হলে আমাদের মৃত্যু হবে এবং মৃত্যুর পর নির্ধারিত সময় কিয়ামত (বিচার দিবস) অনুষ্ঠিত হবে আর তখন আল্লাহর সম্মুখে আমাদের জীবনের সকল প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য তথা কাজ ও লেন-দেনের বিষয়গুলাের পক্ষপাতহীন চুলচেরা হিসাব হবে এবং এরই ভিত্তিতে ফয়সালা হবে জাহান্নামের কঠোর শাস্তি অথবা জান্নাতের অফুরন্ত সুখ ও শান্তি।

দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার মূলনীতি

আজীবন মহাসত্যবাদী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর এসব ওহী নির্ভ বক্তব্য শুনে সে সমাজের ভাগ্যবান ব্যক্তিরা নিজেদের বাপ-দাদার ধর্ম পরিত্যাগ করে ইসলামী আদর্শের পতাকাতলে আশ্রয় নিয়েছেন। জীবন পরিচালনা পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন করে লােহা পুড়ে খাটি সােনায় পরিণত হয়েছেন।

এই ছিলাে বিশ্বনবীর সমাজ সংস্কার আন্দোলনের পটভূমি। হযরত আবু বকর, ওমর, উসমান, আলী, খাব্বাব, খুবাইব, আম্মার, বিলাল (রাঃ)-এর মতাে অসংখ্য পুতঃ পবিত্র চরিত্রের অধিকারী সাহাবাদের একটি টীম তৈরী হলাে। তাদের নিয়ে নবী করীম (সাঃ) মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করলেন।

প্রতিষ্ঠিত হলাে জবাবদীহীমূলক সরকার। আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান নীতির ভিত্তিতে সাদা-কালাের ব্যবধান দূরীভূত হলাে। জাতি-ধর্ম, দলমত, নারী-শিশু, বৃদ্ধ সকলেই তাদের প্রাপ্য অধিকার বুঝে পেলাে। রইলাে না আর মানুষে মানুষে কোনাে ভেদাভেদ, দুর্নীতি, আত্মসাৎ ও চৌর্যবৃত্তির শেষ ক্ষত চিহ্নটুকুও মুছে গেলাে সমাজদেহ থেকে।

ইতিহাস সাক্ষী, পৃথিবীতে সর্বপ্রথম দুর্নীতি মুক্ত সমাজ-রাষ্ট্র উপহার দিয়েছিলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)। তার ইন্তেকালের পর ক্ষমতায় এলেন হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)।

তিনি মদীনা রাষ্ট্রে হযরত ওমর ফারুক (রাঃ)-কে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োেগ প্রদান করলেন। ঐতিহাসিকরা লিখছেনবিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের এক বছর পূর্ণ হবার পর হযরত ওমর (রাঃ) খলীফা হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর নিকট এসে বিচারপতির পদ থেকে পদত্যাগের অনুমতি চাইতে গিয়ে বললেন, এ দেশে আদালত বা বিচারপতির কি প্রয়ােজন?

দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার মূলনীতি

আমার দায়িত্ব পালনের আজ এক বছর পূর্ণ হলাে। এই পুরাে এক বছরে আমার কাছে কোনাে দুই ব্যক্তি একজনের বিরুদ্ধে আরেকজন মামলা দায়ের করতে আসেনি।

সুতরাং আমাকে পদত্যাগ পত্র জমাদানের অনুমতি দিন। খলীফা প্রশ্ন করলেন, এর কারণ কি বলে মনে হয় আপনার কাছে। পুরাে এক বছরে আপনার আদালতে একটি অভিযােগ পত্র বা একটি মামলাও কেননা দায়ের হলাে
?

জবাবে হযরত ওমর (রাঃ) যা বললেন তা নিম্নরূপ‘হে খলীফা! আমার চিন্তায় আমি যেটা পেয়েছি তা হচ্ছে আপনি আমাকে এমন একটি জাতির বিচারপতি পদে নিয়ােগ দিয়েছেন, যে জাতির দ্বীন (জীবন ব্যবস্থা) হচ্ছে, পরস্পরের কল্যাণ কামনা করা, কারােও কোনাে ক্ষতি হয়, অধিকার নষ্ট হয়, এমন কাজ এরা কেউ করে না। এমন কথাও এরা কেউ বলে না।

আর তাদের সংবিধান হচ্ছে কোরআন। কোরআনে বর্ণিত আল্লাহর দেয়া সকল আদেশ তারা মেনে চলে এবং কোরআনে বর্ণিত সকল নিষিদ্ধ কর্ম তারা তা বর্জন করে। তাদের রুটিন মাফিক কাজ হচ্ছে পরস্পর পরস্পরকে ভালাে কাজের আদেশ দেয়া বা উৎসাহিত করা, আর সকল প্রকার খারাপ কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখা।

এ জাতির প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের ও অন্যের অধিকারের সীমানা চেনে, তাই নিজের বা অন্যের অধিকারের সীমানা তারা কোনােক্রমেই অতিক্রম করেনা। এদের একজন অসুস্থ হলে অন্যেরা তার সেবায় এগিয়ে আসে। তাদের কেউ অভাবগ্রস্থ হলে অন্যেরা তার জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।

এমনকি সাময়িকভাবে কেউ কোনাে সমস্যায় পড়লে তার সাহায্যের জন্যেও এ সমাজে লােকের অভাব হয় না। অতএব এই যখন একটি দেশের অধিবাসীদের জাতিয় চরিত্র, তখন কোন্ দুঃখে কেউ কারাে বিরুদ্ধে অভিযােগ নিয়ে বিচারকের দুয়ারে আসবে?

দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার মূলনীতি

পাঠক, এতক্ষণ যে বর্ণনা পড়লেন তা কোনাে কল্প-কাহিনী নয়, এই ছিলাে নবী করীম (সাঃ)-এর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার সুফল- যা রাসূল (সাঃ)-এর বিশিষ্ট সাহাবী দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর (রাঃ)-এর বিবরণে জানতে পারলেন।

ব্যক্তিগতভাবে, দলগতভাবে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে যখন লােকেরা আল্লাহ ও রাসূল। নির্দেশিত আইনের প্রতি উদাসীন হয়, শয়তান তখন তাদেরকে অবৈধ ভােগ-বিলাসী জীবন-যাপনের প্রতি আকৃষ্ট করে।

মানুষ তখন পরকালের জবাবদীহীতা ভুলে গিয়ে সিন্দাবাদের দৈত্যের মতাে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও জনগণের সম্পদের ওপর লােলুপ জিহ্বা বিস্তার করে রাক্ষসের মতাে যা পায় অবলীলাক্রমে তাই গিলতে থাকে- বনও খায় জঙ্গলও খায়। প্রকৃতপক্ষে সমগ্র বিশ্বে সর্বপ্রথম দুর্নীতি মুক্ত সমাজ গঠনে সবথেকে সফল রাষ্ট্র।

প্রধান বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)। তাঁর সফলতার মূল কারণ ছিলাে তিনি মানুষকে ওহীর জ্ঞান দিয়ে তাদের মধ্যে আল্লাহভীতি এবং পরকালে জবাবদীহীমূলক মানসিকতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

আজও যদি সত্যিকার অর্থে আমরা দুনীতি মুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র দেখতে চাই তাহলে সকল নাগরিকদের এবং প্রশাসনের প্রত্যেক স্তরে কর্মরত লােকদের জন্যে নৈতিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবেযেভাবে করেছিলেন নবী করীম (সাঃ)।

এ জন্যে কোরআন মজীদে নিম্ন বর্ণিত মাত্র কয়েকটি আয়াতের প্রতি লক্ষ্য করুন, অপরাধ প্রবণতা দূরীকরণ ও চরিত্র গঠনে এ আয়াতসমূহের প্রভাব কতাে সুদূর প্রসারী।

দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার মূলনীতি

নিঃসন্দেহে আমি মানুষদের সৃষ্টি করেছি তার মনের কোণে যে খারাপ চিন্তা উদয় হয়- সে সম্পর্কেও আমি অবগত আছি। আমি তার ঘাড়ের রগ থেকেও তার অনেক কাছে (অবস্থান করি)। (সূরা কাফ, আয়াত নং-১৬)।

মানুষ (ক্ষুদ্র) একটি শব্দও সে উচ্চারণ করে না যা সংরক্ষণ করার জন্য একজন সদাসতর্ক প্রহরী-তার পাশে নিয়ােজিত থাকে না। (সূরা কাফ, আয়াত নং১৮)

তােমাদের ওপর পাহারাদার নিযুক্ত করা আছে, এরা হচ্ছেন সম্মানীত লিখক (ফিরিশতা) তারা জানে তােমরা যা করছে। (সূরা ইনফিতর, আয়াত নং-১০-১২)

তােমরা তােমাদের মনের মধ্যে যা কিছু আছে তা যদি প্রকাশ বা গােপন করে আল্লাহ তায়ালা (একদিন) তােমাদের কাছ থেকে তা (পুরােপুরি) হিসাব গ্রহণ করবেন, এরপর তিনি যাকে খুশী মাফ করবেন, যাকে ইচ্ছে শাস্তি দিবেন।

আল্লাহ তায়ালা সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান। (সূরা বাকারাহ্, আয়াত নং-২৮৪) – প্রত্যেকের ভালাে-মন্দ কর্মলিপি আমি তার গলায় ঝুলিয়ে রেখেছি, আমি তা কিয়ামতের দিন একটি কিতাব আকারে খুলে তার হাতে তুলে দিবাে।

তাকে বলা হবে ভাজ নিজের কর্মলিপি (এখন) নিজেই পড়ে দেখাে । তুমি নিজেই নিজের হিসাব করার জন্য যথেষ্ট। (সূরা বনি ইসরাঈল, আয়াত নং-১৩, ১৪)

দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার মূলনীতি

• আজ (কিয়ামতের দিন) আমি তােমাদের মুখের ওপর ছিপি এটে দিবাে (তখন) তােমাদের হাতগুলাে আমার সাথে কথা বলবে, পা-গুলাে (আমার কাছে) সাক্ষ্য দিবে এরা কি কাজ করে এসেছে।

(সূরা ইয়াসীন, আয়াত নং-৬৫) হযরত লুকমান (আঃ) তাঁর সন্তানকে নটি উপদেশ দিয়েছিলেন- যা কোরআন মজীদে আল্লাহ তায়ালা উদ্ধৃত করেছেন।

তন্মধ্যে একটি উপদেশ ছিলাে এ রকম* হে প্রিয় বৎস! যদি তােমার কোনাে আমল সরিষার দানা পরিমাণ (ছােটও) হয় এবং তা যদি কোনাে শিলাখন্ডের ভেতরে কিংবা আসমানসমূহেও (লুকিয়ে) থাকে অথবা (যদি তা থাকে) যমীনের ভেতরে তাও আল্লাহ তায়ালা (সামনে) এনে হাজির করবেন। আল্লাহ তা’য়ালা অবশ্যই সুক্ষ্মদর্শী এবং সকল বিষয়ে সম্যক অবগত। (সূরা লুকমান, আয়াত নং-১৬)

অতএব যে ব্যক্তি এক অনুপরিমাণ কোনাে ভালাে কাজ করে (সেদিন) তাও সে দেখতে পাবে। (ঠিক তেমনি) কোনাে মানুষ যদি অনুপরিমাণ খারাপ কাজও করে সে তার (চোখের সামনে) তাও দেখতে পাবে। (সূরা যিলযাল, আয়াত নং৭-৮)

তুমি কি কখনাে অনুধাবন করােনা যে আসমানসমূহ ও যমীনে যা কিছু আছে আল্লাহ তায়ালা তা সবই জানেন। কখনাে এমন হয় না যে তিন ব্যক্তির মধ্যে কোনাে গােপন শলা-পরামর্শ হয় (সেখানে) চতুর্থ হিসেবে আল্লাহ উপস্থিত থাকেন
এবং পাঁচজনের মধ্যে কোনাে গােপন পরামর্শ হয় যেখানে) ষষ্ঠ হিসেবে আল্লাহ থাকেন না।

দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার মূলনীতি

(এ শলা-পরামর্শকারীদের সংখ্যা) এর চাইতে কম হােক বা বেশী হােক তারা যেখানেই থাকনা কেননা আল্লাহ তায়ালা সব সময়ই তাদের সাথে আছেন। অতঃপর কিয়মাতের দিন আল্লাহ তায়ালা তাদের (সবাইকে বলে দিবেন তারা কি কি কাজ করে এসেছে। (সূরা মুজাদিলাহ্, আয়াত নং-৭)

যাবতীয় অদৃশ্য বিষয়ের চাবি তাঁর হাতেই নিবদ্ধ রয়েছে। সেই (অদৃশ্য) খবর তো তিনি ছাড়া আর কেউ জানে না; জলে-স্থলে (যেখানে) যা কিছু আছে তা শুধু তিনিই জানেন (এই সৃষ্টিরাজির মধ্যে) একটি পাতা কোথাও ঝরে না যার (খবর) তিনি জানেন না। (সূরা আনয়াম, আয়াত নং- ৫৯)

মানব জীবনকে পরিচ্ছন্ন ও দুর্নীতি মুক্ত করার লক্ষ্যে এভাবে পরকালে জবাবদীহীতা এবং মৃত্যু পরবর্তী পরকালীন জীবন সম্পর্কিত যত কথা আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন তা একত্রিত করলে গোটা কোরআন মজীদের এক তৃতীয়াংশ অর্থাৎ দশ পারার সমান হবে।

নবী করীম (সাঃ)-এর পবিত্র জবানীতে সাহাবায়ে কেরাম এসব তথ্য জানতে পেরেছেন এবং সেভাবে জীবন গড়েছেন। এ কারণেই নবীর পরেই সাহাবায়ে কেরামের মর্যাদাসম্পন্ন অবস্থান। তাঁরাই ছিলেন বিশ্ব সভ্যতা নির্মাণের এবং দুর্নীতি মুক্ত সমাজ গঠনের সর্বোত্তম মূল স্থপতি।

সমগ্র বিশ্বে তাঁদের কোনো তুলনা নেই। সুতরাং দুর্নীতি মুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের জন্য কোনো দেশের মানব রচিত সংবিধান অনুসরণের চিন্তা-চেতনা হবে চরম আত্মঘাতমূলক নির্বুদ্ধিতা ।

আইন যতোই কঠোর থেকে কঠোরতর হোক, শাস্তি যতোই প্রলম্বিত ও লোমহর্ষক হোক, যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষের মনের গহীনে আল্লাহভীতি সৃষ্টি না হবে, পরকালে জবাবদীহীতার মানসিকতা সৃষ্টি না হবে ততদিন দুর্নীতি সমূলে নির্মূল করা আদৌ সম্ভব নয় । এখানে অপরাধমুক্ত সমাজ-রাষ্ট্রের স্বর্ণালী ইতিহাসের আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই ।

দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার মূলনীতি

নবী করীম (সাঃ)-এর শেষ যুগে মদীনা থেকে এক সুন্দরী যুবতী মেয়ে কোনো এক আত্মীয় বাড়িতে বেড়ানোর উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেছে। পথিমধ্যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো । নির্জন মরুভূমিতে একাকিনী যুবতী মেয়ে ভীত সন্ত্রস্ত পদে দ্রুত তার গন্তব্য স্থলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো।

তাঁর মনে শঙ্কা ছিলো যদি এই মুহূর্তে কোনো পর পুরুষের সম্মুখে আমি পড়ে যাই তাহলে আমার অলঙ্কারাদী তো ছিন্তাই হবেই সেই সাথে নারী জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ সতীত্বও লুণ্ঠিত হবে। হঠাৎ যুবতীর দৃষ্টি গোচর হলো, দূর থেকে এক সুদর্শন যুবক তার দিকেই এগিয়ে আসছে।

যুবতী আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় হতবিহ্বল হয়ে বসে পড়লো। ইতোমধ্যে যুবকটি তাঁর সম্মুখে এসে যুবতীর রক্তশূন্য ফ্যাকাশে ভয়বিহ্বলা চোখের ওপর চোখ রেখে বিনয়ের সাথে বললো, ‘মা! তুমি ভয় পাচ্ছো কেনো! তুমি কোথায় যাবে আমাকে বলে মা, আমি নিরাপদে পাহারা দিয়ে তােমাকে তােমার গন্তব্যে পৌছে দিবাে।

আমাকে দিয়ে তােমার কোনাে অনিষ্ট হবে না। আমার পরিচয় শােননা, আমি মুসলমান।’ এই ছিলাে নবী করীম (সাঃ)-এর রক্ত ও সাহাবায়ে কেরামের জীবন দিয়ে গড়া ইসলাম ও মুসলমানদের ইতিহাস।

ইতিহাসে বর্ণিত এই যুবক আইনের শাসনের প্রতি সম্মান দেখিয়ে বা কঠোর শাস্তির ভয়ে ঐ যুবতীর সাথে অনৈতিক আচরণ করা থেকে বিরত থাকেনি।

দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার মূলনীতি

কারণ সেখানে কোনাে অঘটন ঘটলে তার সাক্ষীও কেউ থাকতাে না এবং বিচারও হতে না। এ যুবকের হাতের মুঠোয় পাওয়া মহাপাপ থেকে যে শক্তি তাকে রক্ষা করলাে তার নাম ‘আল্লাহর ভয়। সুতরাং কেউ না দেখলেও আল্লাহর অতন্দ্র দৃষ্টিকে ফাঁকি দেয়া যাবে না।

এই মানসিকতা সৃষ্টির পূর্বে শতভাগ দুর্নীতি ও অপরাধ মুক্ত সমাজ আশা করা আকাশ কুসুম পরিকল্পনা বৈ আর কিছুই নয়। হযরত আলী (রাঃ) কত সুন্দর কথাই না বলেছেন, “যখন তুমি একাকীত্বে থাকবে তখন আল্লাহ তায়ালাকে আরাে বেশী ভয় করবে।

কারণ ঐ সময় তােমার কৃত অপরাধের যিনি সাক্ষী তিনিই হবেন কিয়ামতে তােমার বিচারক।’ পৃথিবীর ইতিহাস এমন একটি ঘটনাও পেশ করতে পারবে না, যেখানে কোনাে আল্লাহভীরু প্রকৃত অর্থে মুসলমান নিজের পক্ষ থেকে হিংসা, জিঘাংসা, রক্তপাত, মারামারি বা যুদ্ধের জন্ম দিয়েছে।

মক্কা থেকে হিজরতকারী মুহাজিররা মদীনার আনসারদের সাথে গভীর মমতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন, অথচ ঈমান ব্যতীত তাঁদের মধ্যে অন্য কোনাে আত্মীয়তার যােগসূত্র ছিলাে না।

ইতিহাসে আদর্শের শক্তি ও প্রভাবের এটাই একক ও অসাধারণ দৃষ্টান্ত। মদীনার আওস ও খাযরাজ গােত্র পরস্পরের প্রাণের দুশমন ছিলাে। এক গােত্র অপর গােত্রের পরম আপনজনকে হত্যা করেছিলাে।

দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার মূলনীতি

অঢেল অর্থ-সম্পদ ব্যয় করেও তাদের মধ্যে শান্তি স্থাপন করা সম্ভব ছিলাে না এবং মমতার বাগডােরে তাদেরকে বাঁধা সম্ভব ছিলাে না।

কিন্তু একমাত্র আল কোরআনই তাদের হৃদয় থেকে পরস্পরের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ ও হিংসা দূর করে দিয়ে গভীর মমতার বন্ধনে বেঁধে দিয়েছিলাে।

মক্কার মুহাজির ও মদীনার আনসারদের মধ্যে এবং পরস্পরের প্রতি চরম বৈরীভাবাপন্ন মদীনার আওস ও খাযরাজ গােত্রের মধ্যে শুধুমাত্র কোরআনের কারণে ভ্রাতৃ-সম্পর্ক এমনই শক্তিশালী সম্পর্কের রূপ নিয়েছিলাে, যার সামনে রক্তের সম্পর্কও নিষ্প্রভ এবং পৃথিবীর যাবতীয় বন্ধুত্বই ম্লান ও তাৎপর্যহীন হয়ে পড়েছিলাে।

পৃথিবীর জাতিসমূহের ইতিহাসের প্রতিটি পৃষ্ঠায় অনুসন্ধান চালালেও এই ধরনের নিঃস্বার্থ প্রেম-প্রীতি ও ভালােবাসার দ্বিতীয় কোনাে দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে না।’

একমাত্র আল্লাহর ভয়ই তাদেরকে আল্লাহর রাসূলের সামনে তাদের গােপন ভুল-ভ্রান্তির কথা অকপটে স্বীকার করতে বাধ্য করতাে এবং হঠাৎ ঘটে যাওয়া প্রাণদন্ড তুল্য সংঘটিত অপরাধের শাস্তি গ্রহণের জন্য নিজেকে পেশ করতে বাধ্য করতাে।

নিজের অজান্তে কোনাে সময় শয়তানের কুমন্ত্রণায় তাদের দ্বারা ভুল-ভ্রান্তি সংঘটিত হয়েছে আর এর সুযােগ তখন ঘটেছে যখন কোনাে মানব চক্ষু তা অবলােকন করেনি এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিটিকে আইনের ধারা-উপধারা গ্রেফতার করতে অক্ষম হয়েছে, এ অবস্থায় আল্লাহর ভয়ই তখন তীব্র ভাষায় তাকে তিরস্কার করেছে।

আল্লাহর ভয়ের রশি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পা এমনভাবে বেঁধেছে যে, সে ব্যক্তি চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়েছে। আল্লাহর ভয় তার মন-মস্তিষ্কে প্রবল আলােড়ন সৃষ্টি করেছে।

দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার মূলনীতি

তার ভেতরে গােনাহর স্মরণ ও পরকালের শাস্তির বিষয়টি এমন পীড়াদায়ক অবস্থার সৃষ্টি করেছে যে, তাঁর। জীবন থেকে শান্তি ও স্বস্তি বিদায় গ্রহণ করেছে।

শেষ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বাধ্য হয়ে প্রশাসন ও আইন প্রয়োেগকারী কর্তৃপক্ষের কাছে নিজেকে সােপর্দ করে গােপনে সংঘটিত অপরাধের স্বীকৃতি দিয়ে কঠিন দন্ড ভােগের জন্য নিজেকে পেশ করেছে।

এরপর নির্ধারিত চরম দন্ড সে সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নিয়ে এবং হাসি মুখে দন্ড ভােগ করেছে যেন মহান আল্লাহর অসন্তুষ্টির হাত থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারে এবং আখিরাতের কঠিন শাস্তির মােকাবেলায় পথিবীতেই শাস্তি ভােগ করে হাশরের ময়দানে অপরাধ মুক্ত অবস্থায় আল্লাহর দরবারে দাঁড়াতে পারে।

আল্লাহর ভয়ই ছিলাে তাদের আমানত, সততা, নৈতিকতা, সচ্চরিত্রতা ও মহত্ত্বের প্রহরীস্বরূপ। ‘ প্রকাশ্যে-গােপনে, নীরবে-নির্জনে ও জনসমাবেশে আল্লাহর ভয়ই ছিলাে অতন্দ্র প্রহরী।

যেখানে দেখার মতাে কেউ থাকতাে না, এমন নীরব নির্জন স্থান, যেখানে একজন মানুষের পক্ষে যা খুশী তাই করার পূর্ণ সুযােগ থাকতাে, যেখানে কেউ দেখে ফেলবে-এই ভয় ছিলাে না-সেখানেও একমাত্র আল্লাহর ভয়ই তাঁদের নফস তথা প্রবৃত্তির প্ররােচনা ও কামনা-বাসনাকে পরিপূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করতাে।

আল্লাহর দ্বীন তথা ইসলামের বিজয়ের ইতিহাসে সততা, বিশ্বস্ততা, আমানতদারী ও নিষ্ঠার এমন সব ঘটনা বিদ্যমান যে, মানবেতিহাসে এর কোনাে দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে।

একমাত্র আল্লাহ ও পরকাল ভীতির কারণেই এসব কিছু সম্ভব হয়েছিলাে। ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়েছে, মুসলিম বাহিনী পারস্যের তদানীন্তন রাজধানী মাদায়েনে যখন উপস্থিত হয়েছিলাে, তখন সাধারণ সৈন্যবাহিনী যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়লাে।

পারস্য সম্রাটের ধন-রত্ন সংগ্রহ করে একজন হিসাব রক্ষকের কাজে জমা দেয়া হচ্ছিলাে। একজন মুসলিম সৈন্য সবথেকে মূল্যবান ধন-রত্নের স্তুপ এনে যখন হিসাব রক্ষকের কাছে জমা দিলাে তখন উপস্থিত লােকজন তা দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে বললাে, এই লােক যে মূল্যবান ধন-রত্ন এনেছে তা আমরা কখনাে দেখিনি।

দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার মূলনীতি

আমাদের সকলের সংগ্রহ করা সম্পদের তুলনায় এই লােকের একার সংগ্রহ করা সম্পদ অধিক মূল্যবান।’ এরপর একজন লােক সেই লােককে প্রশ্ন করলাে, ‘ভাই, তুমি এসব মূল্যবান ধন-রত্র থেকে কোনাে কিছু নিজের জন্য কোথাও সরিয়ে রেখে আসনি তাে?”

লােকটি মহান আল্লাহ তা’য়ালার নামে শপথ করে বললাে, ‘বিষয়টি যদি মহান আল্লাহ রাব্বল আলামীনের সাথে সম্পৃক্ত না হতাে তাহলে এসব মূল্যবান ধন-রত্ব সম্পর্কে তােমরা কোনাে সংবাদই জানতে পারতে না।

সবটাই আমি সরিয়ে ফেলতাম।’ লােকজন স্পষ্ট অনুধাবন করতে পারলাে, এই লােক যা বলছে তার একটি শব্দও অসত্য নয়। তাঁর নাম-পরিচয় জানতে চাওয়া হলে সে জানালাে, আমি আমার নাম ও বংশ পরিচয় প্রকাশ করলে তােমরা আমার প্রশংসা করবে-অথচ প্রশংসা একমাত্র মহান আল্লাহরই প্রাপ্য।

তিনি যদি আমার এই কাজে সন্তুষ্ট হয়ে আমাকে কোনাে বিনিময় দিতে চান, তাহলে আমি তাতেই সন্তুষ্ট। কথা শেষ করে লােকটি যখন চলে গেলাে, তখন গােয়েন্দাদের মাধ্যমে লােকটির পরিচয় জানা গেলাে যে, লােকটি ছিলাে আবদে কায়স গােত্রের লোেক এবং তাঁর নাম ছিলাে আমের। (তারীখে তাবারী, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা-১৬)

আখিরাতের প্রতি ঈমান আনার পরে তাঁরা মহান আল্লাহর গােলামীর এক সুনির্দিষ্ট বৃত্তের মধ্যে এমনভাবে প্রবেশ করেছিলেন যে, তাঁদের জন্য ঈমান যে বৃত্ত এঁকে দিয়েছিলাে, সেই বৃত্তের বাইরে আসা কল্পনারও অতীত হয়ে পড়েছিলাে।

তাঁরা মহান আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও তার ক্ষমতা মাথা পেতে নিয়েছিলেন এবং অনুগত প্রজা, ভৃত্য ও গােলাম হিসাবে জীবন পরিচালিত’ করতেন। তাঁরা পরিপূর্ণভাবে মহান আল্লাহর সমীপে নিজেদের আমিত্ব, নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব সােপর্দ করে দিয়েছিলেন।

মহান আল্লাহর বিধানের সামনে নিঃশর্তে আনুগত্যের মস্তক অবনত করে দিয়েছিলেন এবং নিজেদের কামনা-বাসনাকে ঈমানের রঙে রঙিন করে নিয়েছিলেন।

তারা এমনভাবে ঈমান এনেছিলেন যে, নিজেদেরকে নিজেদের অর্থ-সম্পদ, শক্তিমত্তা, বীরত্ব, নেতৃত্ব, জ্ঞান-বিবেক, বুদ্ধি ও মােগ্যতার মালিক মনে করতেন না এবং এগুলাে নিজেদের ইচ্ছা অনুসারে ব্যবহারও করতেন না।

তাদের প্রেম-ভালােবাসা, বন্ধুত্ব, শত্রুতা, আত্মীয়তা, অনুরাগ-বিরাগ, লেন-দেন, কারাে সাথে সম্পর্ক স্থাপন ও ছিন্নকরণ সকল কিছুই মহান আল্লাহর ভয়ের অধীন করে দিয়েছিলেন।

দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার মূলনীতি

তাদের হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দন ঈমানের দাবি অনুসারে স্পন্দিত হতাে। তারা নিশ্বাস গ্রহণ করতেন ঈমানের দাবি অনুসারে এবং তা ছাড়তেনও ঈমান নির্দেশিত পন্থায়। ঈমানের বিপরীত জীবনধারা সম্পর্কে তারা খুব ভালােভাবেই অবগত ছিলেন, কারণ তারা জাহিলিয়াতের ছায়াতলেই বর্ধিত হয়েছিলেন।

এ কারণে তারা ঈমানের মর্ম সঠিকভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁরা বুঝেছিলেন, ঈমান আনার অর্থই হলাে, এক জীবন থেকে অন্য জীবনের দিকে অগ্রসর হওয়া।

একদিকে মানুষের প্রভুত্ব ও অন্য দিকে মহান আল্লাহর গােলামী। তারা সুনধাবন করেছিলেন, ঈমান আনার অর্থই হলাে, আমিত্বের অহঙ্কার বিসর্জন দিয়ে একমাত্র আল্লাহর গােলামীকে কবুল করতে হবে।

আমি যখনই ঈমানের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছি, তখনই আমার আমিত্ব বা মতামত বলতে অবশিষ্ট কিছু নেই। স্বেচ্ছাচারিতামূলক কোনাে কাজ আর করা যাবে না। ঈমান আনার পরে আল্লাহর বিধানের মােকাবেলায় আমার নিজস্ব ক্ষমতা বলতে আর কিছুই নেই’।

ঈমান আনার পরে রাসূলের সিদ্ধান্তের মােকাবেলায় কোনাে যুক্তি-প্রমাণ পেশ করা যাবে না। ঈমানের বিপরীত বিধানের সামনে কোনাে মামলা-মােকদ্দমা পেশ করা যাবে না বা নিজের ইচ্ছানুসারে কোনাে সিদ্ধান্তও গ্রহণ করা যাবে না।

আল্লাহর বিধানের মােকাবেলায় সমাজ ও দেশে প্রচলিত কোনাে প্রথার অনুসরণ করা যাবে। ঈমান আনার পরে প্রবৃত্তির অনুসরণ করা যাবে না বা আত্মপূজায় নিমগ্ন থাকা যাবে না।

এসব দিক তারা ভালােভাবে অনুধাবন করেছিলেন বলেই যখনই তারা ঈমান এনেছিলেন, তখনই জাহিলিয়াতের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য, আচার-আচরণ, নীতি-পদ্ধতি ও অভ্যাস পরিত্যাগ করে ইসলামকে তার সর্বপ্রকার বৈশিষ্ট্য ও আবশ্যকীয় বিষয়াদিসহ গ্রহণ করেছিলেন-ফলে তাঁদের জীবনে এক পরিপূর্ণ বিপ্লব সাধিত হয়েছিলাে।

হযরত ফুযালা (রাঃ) নবী করীম (সাঃ)-এর কাছে ইসলাম গ্রহণ করার পরে বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলেন। ইতােপূর্বে তার সাথে এক মহিলার সম্পর্ক ছিলাে। পথে সেই মহিলার সাথে দেখা হলে মহিলা তাঁকে ঘনিষ্ঠভাবে পাবার আগ্রহ প্রকাশ করলাে।

হযরত ফুযালা (রাঃ) সেই মহিলাকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলেন, ‘এখন আর সেই সুযোেগ নেই, আমি ঈমান এনেছি-আমি আল্লাহর গােলাম, এখন আর তােমার সাথে ঘনিষ্ঠ হবার কোনাে অবকাশ নেই।’ (যাদুল মা’আদ, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-২৩২) আল্লাহ ও পরকাল ভীতি তাদের মধ্যে মানবতার সকল শাখা-প্রশাখা ও সৌন্দর্যের প্রত্যেক দিক পরিপূর্ণভাবে বিকশিত ও দৃশ্যমান করেছিলাে।

দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার মূলনীতি

তারা যেখানে যে অবস্থাতেই থাকতেন এবং যেখানেই যেতেন, সেখানে নীতি-নৈতিকতার সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত পেশ করতেন। তাঁরা শাসক হিসাবেই থাকুন অথবা রাষ্ট্রের একজন কর্মচারী হিসাবে, তাদের সর্বদাই সংযত, শুচি-শুভ্র, চরিত্রবান, আমানতদার, বিনয়ী, সততা ও বিশ্বস্ততার প্রতিমূর্তি হিসাবেই দেখতে পাওয়া যেতাে।

প্রতিপক্ষ তাদের সম্পর্কে মন্তব্য করুততা, রাতে তাদেরকে দেখতে পাবে যেন পৃথিবীর সাথে তাদের কোনাে সম্পর্কই নেই এবং ইবাদত-বন্দেগী ছাড়া তাদের অন্য কোনাে কাজই নেই। আর দিনের বেলা দেখতে পাবে, রোযাদার হিসাবে ও প্রতিজ্ঞা পালনকারী হিসাবে।

তারা মানুষকে সৎকাজের আদেশ দেয় এবং অসঙ্কাজ থেকে বিরত রাখে। নিজেদের বিজিত এলাকায়ও তারা মূল্য প্রদান করে খাদ্য দ্রব্য ক্রয় করে খায়। কোথাও প্রবেশ করতে হলে সর্বাগ্রে সালাম প্রদান করে এবং যুদ্ধের ময়দানে এমন দৃঢ় ও সংঘবদ্ধভাবে যুদ্ধ করে যে, শত্রুকে পরাজিত করেই যুদ্ধে বিরতি দেয়।

নিজেদের মধ্যে ন্যায় ও সুবিচার করে আর সাম্যের পরিচয় দেয়। দিনের বেলা তারা অশ্বপৃষ্ঠে আসীন এবং মনে হবে যে, শৌর্য-বীর্য ও বীরত্ব প্রদর্শন করাই যেন তাদের একমাত্র কাজ।’ (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৫৩)

আল্লাহর ভয়ই এভাবেই তাদের গােটা জীবনে পরিপূর্ণ এক বিস্ময়কর বিপ্লব সাধন করেছিলাে। আল্লাহর ও পরকাল ভীতির ওপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে সেই কল্যাণ ও মঙ্গলের সৌরভে সুবাসিত মানব সমাজ ও রাষ্ট্র, যে সমাজ ও রাষ্ট্র পৃথিবীর বুকে নবী করীম (সাঃ) মানব জাতিকে উপহার দিয়েছিলেন।

আজও পৃথিবীর মানুষ যাবতীয় দুর্নীতি শশাষণ-লুণ্ঠন, নির্যাতন-নিপীড়ন, অন্যায়-অত্যাচার, নির্যাতন, নিষ্পেষন থেকে মুক্তি লাভ করে একটি সুখী-সমৃদ্ধশালী, নিরাপত্তাপূর্ণ, শােষণমুক্ত-ভীতিহীন সমাজ ও রাষ্ট্র লাভ করতে সক্ষম হবে, যদি আল্লাহর ও পরকাল ভীতিকে নিজেদের চারিত্রিক ভূষণে পরিণত করতে সক্ষম হয়।

আল্লাহ ও রাসূলকে বাদ দিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুধুমাত্র আমাদের দেশের সেনাবাহিনীই নয়- সমগ্র দুনিয়ার প্রত্যেকটি দেশের সকল বাহিনী একত্রিত হয়ে অভিযান পরিচালিত করলেও দুর্নীতি ও অপরাধ মুক্ত সেই সমাজ-রাষ্ট্র পাওয়া সম্ভব নয়, যে স্বর্ণালী সমাজ-রাষ্ট্র নবী করীম (সাঃ) শুধু মাত্র আল্লাহ ও পরকাল ভীতির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার মূলনীতি

বলাবাহুল্য, দুর্নীতি ও অপরাধ মুক্ত সমাজ গঠনের সেটাই একমাত্র সর্বোত্তম মূলনীতি, যে মূলনীতি নবী করীম (সাঃ) বাস্তবায়ন করেছিলেন।

যে কোনাে ব্যধির মূল উৎস খুঁজে বের করতে না পারলে এলােপাথাড়ি চিকিৎসায় রােগ নির্মূল না করে নতুন জটিলতাই সৃষ্টি করে। অনুরূপভাবে আমাদের বর্তমান সমাজ ব্যধির মূল কারণ নৈতিকতার ধ্বস। পরকালে জবাবদীহীতার প্রতি উদাসীনতা, আল্লাহ ও রাসূলের বিধান সম্পর্কে চরম অজ্ঞতা ও মূর্খতা।

এ মহাসঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সকল পর্যায়ের প্রতিটি দায়িত্বশীল তার নিজস্ব পরিমন্ডলে নিজে ভালাে হবার ও অন্যকে ভালাে বানাবার চেষ্টা অব্যহত রাখতে হবে।

সকল প্রকার দুর্নীতি থেকে নিজে বাঁচতে হবে অন্যকেও দুর্নীতি থেকে বিরত রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা নিরন্তর চালাতে হবে। এবং শিক্ষা ব্যবস্থায় আনতে হবে আমূল পরিবর্তন, যাতে করে শিশু তার প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে কোরআন-হাদীসের মাধ্যমে তাদের মধ্যে নৈতিক মূলবােধের সৃষ্টি হয়।

মনে রাখতে হবে, এর কোনাে বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে অমুসলিম শিক্ষার্থীদের বেলায় তাদের ধর্ম শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিত। কারণ ধর্মীয় মূল্যবােধ ছাড়া মানুষের চরিত্র ভালাে করার অন্য কোনাে পথ খােলা নেই।

অন্যথায় নিম্ন বর্ণিত হাদীসের সতর্ক বাণীর প্রতি লক্ষ্য করুনহযরত হােয়ফা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, তােমরা পরস্পরকে অবশ্যই ভালাে কাজের আদেশ করবেই এবং অন্যায় কাজের নিষেধ বা প্রতিরােধ করবেই।

যদি তােমরা এ দায়িত্ব পালন না করাে তাহলে তােমাদের মধ্যের সব থেকে দুষ্ট (কঠোর প্রকৃতির লােকদের তােমাদের শাসক বানিয়ে দেয়া হবে।

তখন তােমাদের নেককার লােকেরা এ অবস্থা থেকে নিস্তার লাভের জন্য যত দোয়াই করুক, আল্লাহর দরবারে তা মঞ্জুর হবে না।’ (তিরমিযী)

পরিশেষে আমাদের বর্তমান বিপর্যয়ের কারণ সমূহের মধ্যে এখানে আমি মৌলিক তিনটি কারণ উল্লেখ করতে চাই :একঃ মহাগ্রন্থ আল কোরআন থেকে বিচ্যুতিঃ যে কোরআন মুসলমানদের শক্তির উৎস, যে কোরআন মুসলমানদেরকে দুনিয়ার নেতৃত্বের আসনে বসিয়ে ছিলো, বিগত দুই হাজার বছরের প্রায় ১২শ বছর ধরে পরিচিত বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশী এলাকা শাসন করিয়েছিলাে, সেই কোরআনের সাথে তাদের সম্পর্ক শুধু সওয়াবের নিয়তে না বুঝে তিলাওয়াত করা ছাড়া আর কিছুই বাকী নেই।

দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার মূলনীতি

কোরআনের আলােকে জীবন গঠন, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-সংস্কৃতি ও রাজনীতিসহ জীবনের বিশাল অঙ্গন থেকে কোরআনকে বিসর্জন দেয়া হয়েছে।

দুইঃ রাসূল (সাঃ)-এর নেতৃত্বের প্রতি দুর্ভাগ্যজনক বিমুখতাঃ আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন* তােমাদের রাসূল তােমাদের জন্য যা কিছু আনয়ন করেছেন তা গ্রহণ করাে আর যা কিছু নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকো। (সূরা হাশর, আয়াত নং-৭)

আল কোরআন থেকে মুখ ফেরানাে এবং তাঁর প্রিয় রাসূলকে জীবনের সকল ক্ষেত্রে নেতৃত্বের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করার ব্যাপারে অনীহা- যা মুসলিম উম্মাহকে গােমরাহ করে অধঃপতনের অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করেছে।

তিনঃ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠার প্রতি অনীহাঃ নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, ‘তােমাদের সকলকেই তােমাদের অধীনস্থদের ব্যাপারে জবাবদীহী করতে হবে।’ (বােখারী) এ হাদীস অনুযায়ী দেশের রাষ্ট্র প্রধান- সরকার প্রধান থেকে শুরু করে গৃহকর্তা পর্যন্ত সকলকেই কিয়ামতের কঠিন বিচার দিবসে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতে পারে।

এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালকদের দায়-দায়িত্ব সর্বাধিক। এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালাকে বেশী ভয় করা প্রয়ােজন। ক্ষমতা আছে বলেই জনগণকে নিজের ইচ্ছে মতাে পরিচালনার এখতিয়ার কাউকে দেয়া হয়নি।

আল্লাহ তা’য়ালার অমােঘ বিধানে গতকাল পর্যন্ত যিনি প্রভাবশালী প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রী ছিলেন আজ তিনি কয়েদখানার আসামী; এসব দৃষ্টান্ত চোখে দেখার পরও যেসব রঙ্গীন চশমাধারী ক্ষমতা লােভীদের শিক্ষা হয়না, এসব জাত পাগলদের হিদায়াত কি করে হবে? ইসলামী বিধান অনুযায়ী সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা দ্বীনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

অথচ এ ক্ষেত্রেও রয়েছে মুসলিম নামধারী ব্যক্তিবর্গের মধ্যে চরম বিতর্ক এবং এসব ব্যক্তিবর্গ হচ্ছেন তারা, যেসব ব্যক্তিবর্গ সামাজিক, রাজনৈতিক, ব্যবসা-বাণিজ্য ও এনজিওর মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং শক্তিশালী মিডিয়াগুলােরও নিয়ন্ত্রণকারী।

দেশ ও জাতির এ নৈতিক অবক্ষয়ের ক্রান্তিলগ্নে ক্ষমতাসীনদের উচিৎ দেশের রাজধানী থেকে শুরু করে সকল জেলা-উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যন্ত সকল উল্লেখযােগ্য স্থানগুলােয় সেমিনার, সিম্পােজিয়াম ও আলােচনা সভার আয়ােজন করে জনগণকে কোরআন-হাদীসের দৃষ্টি ভঙ্গিতে নৈতিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।

দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার মূলনীতি

আর প্রচার মাধ্যমকেও এ কাজে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে হবে। লক্ষ্যণীয়, যে কোনাে মুসলিম দেশের তুলনায় আমাদের দেশের মহিলারা এখনাে পর্দা কম করেন না, বয়স্ক ব্যক্তিদের প্রতি কিশাের, তরুণ-যুবকদের আদব-কায়দা, ভক্তি-শ্রদ্ধা একেবারে কমে যায়নি। জুমুআর দিন মসজিদসমূহে অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থান সঙ্কুলান হয় না।

মানুষের মৌলিক মানবিক গুণাবলী এখনও নিঃশেষ হয়ে যায়নি। নৈতিক অবক্ষয়ের প্রলয়ঙ্করী ঝড়াে হাওয়ার মধ্যে এখনাে উপরােক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ সমাজে অবশিষ্ট থাকার মূল কারণ হলাে, দেশের তিন লক্ষাধিক মসজিদের ইমামদের প্রতি জুমুআয় প্রদত্ত শিক্ষণীয় বক্তব্য।

মদ্রসাসমূহে মৌলিক দ্বীনি শিক্ষা, দেশব্যাপী ওলামা-মাশায়েখদের ওয়াজ মাহফিল, তাফসীর মাহফিল, সীরাত মাহফিল ও সর্বোপরি দ্বীনি সংগঠনের পক্ষ থেকে ব্যাপক নৈতিক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা।

কোনাে দুষ্ট চক্রের কুপরামর্শে এসব দ্বীনি কর্মতৎপরতা বন্ধ করে দেয়ার চাতুর্য অবলম্বন করা হলে তা হবে দেশ ও জাতির জন্য সুদূর প্রসারী আত্মঘাতী।

আমাদের দেশ একেবারেই হত-দরিদ্র দেশ নয়। আমাদের রয়েছে আবাদযােগ্য বিশাল কৃষি ভূমি, গবাদী সম্পদ, বনজ সম্পদ, গ্যাস সম্পদ, পানি সম্পদ, মৎস সম্পদ, খনিজ সম্পদ সর্বোপরি ১৪কোটি মানব সম্পদের ২৮ কোটি কর্মক্ষম হাত। অভাব যা তা শুধু সৎ ও যােগ্য নেতৃত্বের।

দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার মূলনীতি

এ অভাব পূরণ করতে পারলে আমাদের দেশ হতে পারতাে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডের মতাে। ওষুধ যতােই খাঁটি হােক- সেবন না করলে রােগ নিরাময়ের কোনাে সম্ভাবনা নেই।

অনুরূপভাবে নসীহত যতােই বিজ্ঞান ও যুক্তিসম্মত এবং মণি-মুক্তা সদৃশ মূল্যবান হােক, তা আমল না করলে কোনাে লাভ নেই। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে মহাসত্য অনুধাবন করে তা অনুসরণের তাওফীক দিন- আমীন।

মাওলানা দেলাওয়ার হােসাইন সাঈদী সাহেব কর্তৃক লিখিত এ নিবন্ধটি দৈনিক নয়া দিগন্ত, দৈনিক সংগ্রাম ও সাপ্তাহিক সােনার বাংলা পত্রিকায় উপসম্পাদকীয় কলামে ‘দুর্নীতি মুক্ত সমাজ গড়ার মূলনীতি’ শিরােণামে প্রকাশিত হয়।

তথ্যসূত্র: পাঠাগার

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *