Sign In

বিশ্বকোষের ভাষায় সময় বা কাল

বিশ্বকোষের ভাষায় সময় বা কাল

প্রিয় বন্ধুরা আজকে আমরা বিশ্বকোষের ভাষায় সময় বা কাল সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করব। রহস্যময় মহাবিশ্ব সময় বা কাল একটা মহারহস্যের বিষয়। এই আর্টিকেল- সময় বা কাল নিয়ে বিস্তারিত জানবো।

আমাদের পূর্ববর্তী আলোচনায় শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনা ও ব্যবস্থাপনার দক্ষতা সম্প্রসারণ সম্পর্কে জেনেছি আপনারা যারা পড়েননি তারা লেখাটির উপর ক্লিক করে পড়ে নিতে পারেন।

বিশ্বকোষের ভাষায় সময় বা কাল প্রাথমিক ধারণা ও অনুভূতি

বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ হতে সময় বা কাল সম্পর্কে ধারণা নানাভাবে নির্দেশ করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ দার্শনিক, প্রাকৃতিক মনোবৈজ্ঞানিক ও জীববৈজ্ঞানিক। যদিও এ বিষয়ে মতৈক্য স্থাপিত হয়নি তথাপি সচরাচর পরিমাপযোগ্য সময় ও অভিজ্ঞতায় অনুভূত কালের মধ্যে পার্থক্য করা হয়।

সময় সম্পর্কে অমীমাংসীত সমস্যাসমূহের মধ্যে রয়েছে এর বাস্তবতা বা অবাস্তবতা (এর বস্তুনিরপেক্ষতা বা বস্তু সাপেক্ষতার সহিত সংশ্লিষ্ট), কাল এবং অনন্তকাল-মহাকালের মধ্যে পার্থক্য, সবশেষে সময়ে বা কালের প্রকৃতি (বিরতিহীন বা পারমাণবিক); (বিশ্বকোষের ভাষায় সময় বা কাল)

মানুষের সাধারণ ধারণা অনুসারে সময়ের বাস্তব সত্ত্বা আছে এবং তা সর্বদা একইভাবে প্রবহমান; অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত সময়ের মধ্যে এবং পূর্ব ও পরের সময়ের মধ্যে পার্থক্য করা হয়;

আর ঘটনাবলীর পূর্ণ সমকালীনতার সম্ভাব্যতা স্বীকার করা হয়। যাহা হউক এখন অধিকাংশ পদার্থবিদ বিভিন্ন সঞ্চরণশীল মণ্ডলে ঘটনাবলীর সমকালীনতাকে মণ্ডলসমূহের সঞ্চয়ন ও পর্যবেক্ষকের গতির সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত (আপেক্ষিক) বলে বিবেচনা করেন।

বিশ্বকোষের ভাষায় সময় বা কাল

প্রাথমিক ধারণা ও অনুভূতি

সময় একটি স্বাধীন সত্ত্বা এই স্বজ্ঞাত অভিমতের বদলে পদার্থবিদ্যায় এ ধারণা প্রচলিত হয়েছে যে সময় ও স্থান (দেশকাল) হল একটি চতুমাত্রিক বিশ্বের দুটি অবিচ্ছেদ্য দিক।

বিভিন্নরূপ কাল পরিমাপের ভিত্তি হল কোন পুনঃ পুনঃ সঙ্ঘটনশীল প্রাকৃতিক ব্যাপার যথা, পৃথিবীর নিজ অক্ষরেখার চারদিকে আবর্তন-এর দ্বারা সৌর সময় পরিমাপ করা হয়, এবং কোন নক্ষত্রের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হলে নাক্ষত্রিক সময় (sidereal time) পরিমাপ করা হয়। বিভিন্ন ঋতু বা চন্দ্রকলাসমূহের পুনঃ আবির্ভাব ও কাল পরিমাপের ভিত্তি স্বরূপ গৃহীত হয়েছে। (বিশ্বকোষের ভাষায় সময় বা কাল)

সৌরদিবসগুলির দৈর্ঘ্য সমান নয় বলে আধুনিক কালপরিমাপের ভিত্তি হল গড় সৌরদিবস। সূর্যের আপতগতি পশ্চিম অতিমুখী বলে পশ্চিমদিকে প্রতি এক ডিগ্রী দ্রাঘিমার জন্য স্থানীয় সময় হচ্ছে চার মিনিট পরবর্তী।

প্রমাণ সময় বা স্টান্ডার্ড টাইম

প্রমাণ সময় বা স্টান্ডার্ড টাইম ইংলন্ডের গ্রীনিচস্থিত রাজকীয় মানমন্দির কর্তৃক পরিমাপিত গড় সৌরদিবসের উপর নির্ভর করে নির্দ্দিষ্ট হয়েছে;

১৮৮৪ সন থেকে সর্বসম্মতিক্রমে গ্রীনিচের দ্রাঘিমাকে ০° শূন্য ডিগ্রীর দ্রাঘিমা বলে স্বীকার করা হয়। পৃথিবীর ৩৬০° পরিধিটিকে পনের ডিগ্রী করে সমান ২৪টি সময়-বলয়ে বিভক্ত করা হয়, প্রত্যেকটি বলয় গ্রীনিচ সময় হতে কোন পূর্ণসংখ্যক ঘন্টার পার্থক্য স্থানীয় সময় দেখায়।

প্রমাণ সময় বা স্টান্ডার্ড টাইম

সূর্য যখন কোন স্থানের আকাশে এর আপাত গতিপথের উচ্চতম বিন্দুতে পৌঁছে, তখন ঐ স্থানের স্থানীয় আপাত মধ্যাহ্ন এবং যখন উহা গতিপথে আকাশের নিম্নতম বিন্দুতে পৌঁছে তখন স্থানীয় আপাত মধ্যরাত্রি; 

পরপর দুটি মধ্যরাত্রির মধ্যবর্তী কালটা হল এক আপাত সৌরদিবস; এই সময়ই সূর্যঘড়ি দ্বারা মাপা যার। ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে পৃথিবী সূর্যের নিকটতম হয় বলে পৃথিবী দ্রুততর গতিতে ঘুরে, জুন ও জুলাই মাসে সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যে দূরত্ব সর্বাধিক বিধায় তখন পৃথিবী তুলনামূলকভাবে ধীরগতিতে সঞ্চরণ করে। (বিশ্বকোষের ভাষায় সময় বা কাল)

এ কারণে পৃথিবীর দৈনিক আবর্তনের সময় সকল ঋতুতে সমান হয় না । অধিকন্তু সূর্যের আপাত গতি সৌর অয়ন পথে এবং এই পথ খ-বিষুবের সঙ্গে একটি কোণ ২৩.৫০° করে থাকে; 

যখন সূর্য বিষুব রেখার সমান্তরাল চলে

সূর্য যখন অয়নান্ত বিন্দুদ্বয়ের নিকটে থাকে (যখন সূর্য বিষুব রেখার সমান্তরাল চলে) তখন দিবারাত্র বড় হবার প্রবণতা দেখায়, আবার বিষুব বিন্দুদ্বয়ের নিকট পৌঁছলে দিবারাত্র ক্ষুদ্রতর হবার প্রবণতা দেখায়। 

এ কারণেই গড় সময়ের প্রচলন হয়েছে। সৌরদিবসের দ্বিপ্রহর ফেব্রুয়ারি মাসে গড় সৌর দ্বিপ্রহরের প্রায় ১৫ মিনিট পরে এবং অক্টোবরে প্রায় ১৬ মিনিট আগে হয়। প্রমাণ-সময় গড় সৌরদিবস অনুসারে পরিমাপ করা হয়।

যখন সূর্য বিষুব রেখার সমান্তরাল চলে

কালপ্রবাহ অবিচ্ছিন্ন, এর আদিও নেই, অন্তও নেই। আমরা চর্মচক্ষে সে গতি দেখতে পাই না, কারণ কালের কোনও বাস্তব অস্তিত্ব নেই, কিন্তু কাল আছে এবং তা নিত্য। দেশ বা স্পেসের কোনও স্থানে যখন কার্যকারণ শৃঙ্খলায় ঘটনাবলী ঘটে যায় তখন তাদের ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করে উপলব্দি হয় যে ঐগুলি কালের সহিত ওতপ্রোতভাবে শেড়িত।

তাই কালই ঘটনার নিয়ন্ত্রক এবং কালের পটভূমিকায় যাবতীয় নৈসর্গিক ঘটনা ঘটে থাকে। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, বেধ দেশের এই তিন মাত্রা এবং কালের একটি মাত্রা নিয়ে বিজ্ঞানী টনকস্কির চতুর্মাত্রিক জগৎ গঠিত । কিন্তু দুই ঘটনার অর্ন্তবর্তী সময়কে মাপতে হলে মানদণ্ড চাই, চাই সময়ের একক।

মানুষের কালজ্ঞান

কয়েকটি নৈসর্গিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে মানুষের কালজ্ঞান জন্মে, যথা—দিবা ও রাত্রির পুনরাবর্তন, চন্দ্রকলার হ্রাস-বৃদ্ধির আবর্তনচক্র এবং বাৎসরিক ঋতুপর্যায়। 

প্রথমটির কারণ পৃথিবীর আহ্নিক গতি, দ্বিতীয়টির কারণ চন্দ্রের পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ ও তৃতীয়টির কারণ পৃথিবীর স্বীয় কক্ষে বার্ষিক পক্তি। অবশ্য সর্বক্ষেত্রে সূর্যের অবস্থিতির জন্যই এ ঘটনাগুলি দৃষ্টিগোচর হয়ে থাকে।

জ্যোর্তিবিদের গণনায় নাক্ষত্রকাল বা সাইডিরিয়াল টাইম ব্যবহৃত হয়, কিন্তু মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় প্রয়োজন হয় সৌরকালের। (বিশ্বকোষের ভাষায় সময় বা কাল)

নাক্ষত্রকাল গণনায় প্রকৃতপক্ষে কোনও নক্ষত্রের আপাত আবর্তনকাল না ধরে ভূ-চক্রের আদি বিন্দুর আবর্তনকাল ধরা হয়; এ বিন্দুটি বাসন্ত বিষুধবিন্দু (ভার্নাল ইকুইনক্স)। সূর্যের এক পাক ঘুর্ণনে হয় এক সৌরদিবস, ইহা নাক্ষত্রদিবস অপেক্ষা কয়েক মিনিট বেশি।

ঘড়ি ধরে দেখলে দেখা যাবে যে

পৃথিবীর আবর্তনকাল = ২৩ ঘ. ৪৬ মি. ৪.১ সে.

এক নাক্ষত্রদিবস = ২৩ ঘ. ৫৬ মি. ৪.০৯১ সে.

এক মধ্যম সৌরদিবস = ২৪ ঘ. (মীন সোলার ডে)

বাসন্তবিষুব-বিন্দুর পশ্চাৎ-চলনের (প্রিসেশন) জন্য এক নাক্ষত্রদিবস পৃথিবীর আবর্তনকাল হতে সামান্য কম। এক সূর্যোদয় হতে পরবর্তী সূর্যোদয় কাল হল এক সৌরদিবস;

কিন্তু এ কাল পরিমাণ বৎসরের সব দিনে সমান থাকে না, এর কারণ পৃথিবীর সূর্য প্রদক্ষিণকারী বার্ষিক গতিটি সমগতি বিশিষ্ট নয় এবং পৃথিবীর কক্ষতলীয় ক্রান্তিবৃত্তটি (ইক্লিপটিক) বিষুবরেখার (সিলেসটিয়াল ইকোয়েটার) সহিত সমতলে নেই, এদের মধ্যে গতির পরিমাণ ২৩°২৭।

এ কারণে পৃথিবীর কক্ষগতির গড় নির্ধারণ করে মধ্যম সৌর সময়ের হিসেব করা হয়েছে। মোটামুটি ৩৬৫.২৫ দিনে বৎসর ধরে একদিনের গড় গতি হল ৫৯/৮°২৫′, অর্থাৎ ১ ডিগ্রির সামান্য কম। এই মধ্যম সৌর সময়কে ভিত্তি করে আমাদের সাধারণ ঘড়ি সময় নির্দেশ করছে। (বিশ্বকোষের ভাষায় সময় বা কাল)

কাল-সমীকরণ বা ইকোয়েশন অফ টাইম

বাস্তব সূর্য বিষমগতি, কিন্তু মধ্যম সৌরকাল নির্দেশক অবাস্তব সূর্য সমগতি । সূর্যঘড়ি (সান ডায়াল) বাস্তব সূর্যের গতির সময়-নির্দেশক। এই দুই সময়ের অন্তরকালকে বলে ‘কাল-সমীকরণ’ বা ইকোয়েশন অফ টাইম।

কাল-সমীকরণ বা ইকোয়েশন অফ টাইম

কাল-সমীকরণ কয়েক মিনিটের সময়ের তফাত, তা কখনও ধনাত্মক, কখনও ঋণাত্মক। বৎসরে মাত্র চারদিন উহা শূন্য হয়, অর্থাৎ ঐ চারদিন সূর্যঘড়ি ও সাধারণ ঘড়ির সময় একেবারে মিলে যায়।

উক্ত নাক্ষত্র ও সৌর উভয় সময়ই পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে স্থানীয় সময় নির্দেশ করে। দ্রাঘিমাংশ ১৫ ডিগ্রি ব্যবধানে থাকলে ১ ঘন্টা সময়ের ব্যবধান হবে। গ্রীনিচ সময় থেকে বাংলাদেশের স্থানীয় সময় ৬ ঘন্টা বেশি অর্থাৎ গ্রীনউইচে মধ্যাহ্ন ১২টা হলে ঢাকায় তখন বিকেল ৬টা।

এক নাক্ষত্র বৎসর (বিশ্বকোষের ভাষায় সময় বা কাল)

সূর্যের চারদিকে একবার প্রদক্ষিণ সম্পূর্ণ করতে পৃথিবীর যে সময় লাগে তাকে বলে এক নাক্ষত্র বৎসর; এর অর্থ-ভূচক্রস্থিত এক নক্ষত্র (ধরা যাক মঘা নক্ষত্র) হতে পুনরায় সেই নক্ষত্রে সূর্যের আপাত প্রত্যাবর্তনকাল এক নাক্ষত্রবর্ষ;

কিন্তু ঐ চক্রের বাসন্তবিষুব- বিন্দু হতে পরবর্তী ঐ বিন্দু স্থান পর্যন্ত গমন-সময় হল এক ঋতুবর্ষ বা সায়নবর্ষ (ট্রপিক্যাল ইয়ার)। বিষুব বিন্দুটি নক্ষত্রের মত স্থির থাকলে নাক্ষত্রবর্ষ ও সায়নবর্ষ সমপরিমাণ হত, কিন্তু ঐ বিন্দুটি বৎসরে মোটামুটি ৫০ ́ সরে যাওয়ায় সায়ন বর্ধমান ২০ মিনিট ২৪ সেকেন্ড কম হচ্ছে।

এক নাক্ষত্র বৎসর (বিশ্বকোষের ভাষায় সময় বা কাল)

খ-মেরু ক্রান্তিবৃত্তের মেরুর চারদিকে বৎসরে একটি ৫০ ́ কোণ অঙ্কিত করে ঘুরছে এবং তার চারদিকে এক পাক ঘুরে আসতে সময় লাগবে ২৬০০০ বৎসর। (বিশ্বকোষের ভাষায় সময় বা কাল)

নক্ষত্রপুঞ্জের মধ্য দিয়ে উক্ত মৃদুমন্দ গতি আর একটি কাল গণনা সূচিত করছে। মহাভারতের যুদ্ধের কাল নির্ণীত হয়েছে অনেকটা অয়ন চলনের হার গণনা থেকেই।

এতদ্ব্যতীত সূর্যের এক অনুসূর (পেরিহেলিয়ন) হতে সেই অনুসূরে ফিরে আসতে একটু বেশি সময় লাগে, কারণ অনুভর একটা পূর্বদিকে বাৎসরিক গতি আছে যার ১১ ২৫ ́ হচ্ছে অবস্থান। এই প্রত্যাবর্তনকালকে বলে ব্যতিক্রান্ত বৎসর’ বা অ্যানোম্যালিস্টিক ইয়ার

নিম্নে বর্ধমানগুলির পরিমাণ দেয়া গেল

সায়নবর্ষ৩৬৫.২৪২১৯৫৫ দিন = ৩৬৫ দি. ৫ ঘ. ৪৮ মি. ৪৫.৭ সে.
নাক্ষত্রবর্ষ ৩৬৫.২৫৬৩৬২৫ দিন = ৩৬৫ দিন ৬ ঘ. ৯ মি. ৯.৭ সে.
ব্যতিক্রান্ত বর্ষ৩৬৫.২৫৯৫৫০০ দিন = ৩৬৫ দিন ৬ ঘ. ১৩ মি. ৪৫.১ সে.
আর্যভট্ট ও বরাহ মিহিরের সূর্য সিদ্ধান্ত মতে বৎসর হচ্ছে৩৬৫.২৫৮৭৫ দিন = ৩৬৫ দিন ৬ ঘ. ১২.মি. ৩৬ সে.
টলেমির মতে৩৬৫.২৫৬৮১৩ দিন = ৩৬৫ দিন ৬ ঘন. ৯ মি. ৪৮.৬ সে
ওমর খৈয়ামের মতে৩৬৫.২৪২৪ দিন (অপসল হিসেব থেকে ০,০০০২ দিন বেশি—ফলে ৫০০০ বৎসরে ১ দিনের তারতম্য ঘটবে আর বর্তমান হিসেব মতে প্রতি ৩৩৩৩ বৎসরে ১দিন ভুল হবে; দেখা যায় খৈয়ামই সবচেয়ে বেশি ঠিক)

নাবিক-পঞ্জিকায় বর্তমানে যে ‘এফিমেরিস সময় ব্যবহৃত হচ্ছে তা উক্ত সায়নবর্ষের বা ৩১৫৫৬৯২৬ সেকেন্ডের এক ভাগকে ‘এফিমেরিস সেকেন্ড’ ধরে, একেই মৌলিক সময়ের একক ধরা হয়েছে।

এফিমেরিস দিবস

এ হিসেবে এক ‘এফিমেরিস দিবস’ হল ৮৬৪০০ (২৪ x ৬০ × ৬০) সেকেন্ড। এফিমেরিস সময়ের সমান হচ্ছে সর্বজনীন সময় + কালশোধন।

এ কালগণনার আদিবিন্দু হল ১৯০০ খৃস্টাব্দের ১লা জানুয়ারি তারিখের বেলা দুপুর (সর্বজনীন সময় বা এফিমেরিস সময়)। নাবিক-পঞ্জিকায় প্রতি বৎসরে দৈনন্দিন কালশোধন দেয়া থাকে। উভয় সময়ের পার্থক্য কয়েক সেকেন্ড মাত্র।

লৌকিক ব্যবহারের জন্য বর্ষ পূর্ণসংখ্যাসূচক ৩৬৫ দিনের, চতুর্থ বৎসরে একটি অতিরিক্ত দিন ধরে ৩৬৬ দিন করা হয়। উহাই অধিবর্ষ বা লিপইয়ার। (বিশ্বকোষের ভাষায় সময় বা কাল)

সায়নবর্ষের অতিরিক্ত ৫ ঘ. ৪৮ মি. ৪৬ সে. চারি বৎসরে জমা হয়ে ২৩ ঘ. ১৫ মি. ৪ সে. হয়; একে ২৪ ঘ. ধরে অধিবর্ষে ১ দিন বেশি করা হয় ।

এই সংশোধনে প্রায় ৪৫ মি. অতিরিক্ত ধরায় আর একটি সংশোধন আবশ্যক। পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি ১৫৮২ খৃস্টাব্দে এই সংশোধন প্রচলিত করান।

যেসব বর্ষ ৪ দ্বারা বিভাজ্য সেগুলি অধিবর্ষ। কিন্তু ৪০০০, ৮০০০, ১২০০০, বর্ষ ৪ দ্বারা বিভাজ্য হলেও অধিবর্ষ নহে। অবশ্য অন্যান্য শতাব্দীর শেষ বর্ষ ৪ দ্বারা বিভাজ্য হলে সেগুলি অধিবর্ষ বলে বিবেচিত হয় । এই সংশোধনে অনেকটা কালশোধন সম্পূর্ণ হল।

চন্দ্রের ঘুর্ণনকাল হতে মাসের উৎপত্তি

চন্দ্রের ঘুর্ণনকাল হতে মাসের উৎপত্তি হয়েছে এজন্য চন্দ্রকে বলে ‘মাসকৃৎ’। এক অমাবস্যা হতে পরবর্তী অমাবস্যার পূর্বদিন পর্যন্ত কালকে ‘চান্দ্রমাস’ বা লুনেশান্ বলে।

সাধারণত, চান্দ্রমাসের মান ২৯ দিন. ১২ ঘ. ৪০ মি. ২.৮ সে ধরা হয়। পঞ্জিকার প্রধান কার্য চান্দ্রবৎসর ও সৌর বৎসরের সমন্বয় সাধন। ১৩০০ খৃস্টপূর্বাব্দে বেদাঙ্গজ্যোতিষে ৬২টি চান্দ্রমাস ও ৬০টি সৌরমাসের কথা বলা আছে।

চান্দ্রমাস আসন্ন ২৯.৫৩ দিনে ধরিলে ৬২ চান্দ্রমাসে হয় ১৮৩০.৮৬ দিন; এবং বৎসরে ৩৬৬ দিন ধরিলে ৫ বৎসরে দিন সংখ্যা হয় ১৮৩০। এই দুই অতিরিক্ত মাস হল ‘মলমাস’ (ইন্টার-ক্যালারি মান্থ)। এই পাঁচ বৎসরের যুগ আরম্ভ হত উত্তরায়নারম্ভ অমাবস্যায় ধনিষ্ঠা নক্ষত্র সংযোগে।

সৌর বৎসর

সৌর বৎসর ৩৬৫/৩৬৬ দিনে হওয়ায় এবং চান্দ্রবৎসর ৩৫৩/৩৫৪/৩৮৩/৩৮৪ দিনে হওয়ায় কি সৌর কি চান্দ্র যে কোনও পঞ্জিকা অনুসারে দুই ঘটনার মধ্যবর্তী সময় নির্ণয় করা দূরুহ হয়ে পড়ে, এ জন্য যোশেফ স্ক্যালিজার (১৫৪০-১৬০৯ খৃ:) ১৫৮২ সনে এক প্রণালীর উদ্ভাবন করলেন যাতে বিশিষ্ট ঘটনাসমূহ দিন সংখ্যা দ্বারা নির্দেশ করা যেতে পারে।

তিনি ৪৭১৩ খৃস্টপূর্বাব্দের ১লা জানুয়ারিকে কালের আদিবিন্দু (জিরো আওয়ার) ধরে পরবর্তী ৭৯৮০ বৎসর কালকে ‘জুলীয়কাল’ বললেন এবং জুলীয় দিবসে ঘটনাবলীর তারিখ নির্দেশ করলেন। (বিশ্বকোষের ভাষায় সময় বা কাল)

  • কল্যব্দ : ১৭-১৮ ফেব্রুয়ারি ৩১০২ খৃষ্টপূর্বাব্দ : জুলীয় দিবস ৫৮৮৪৬৫
  • শকাব্দ : ১৫ মার্চ ৭৮ খৃস্টাব্দ : জুলীয় দিবস ১৭৪৯৬২১

৪৭৬ খৃস্টাব্দে অর্থভট প্রথম এরূপ কাল গণনাকে ‘অর্থান’ বলে গেছেন । তিনি আর একটি যুগের কথা বলে গেছেন, তার নাম মহাযুগ। ৪৩,২০,০০০ বৎসরে এক মহাযুগ।

অর্থভটের পূর্বোক্ত বর্ধমান (বিশ্বকোষের ভাষায় সময় বা কাল)

সূর্য সিদ্ধান্ত মতে এক মহাযুগের চারিভাগ এরূপ সত্যযুগ (১৭,২৮,০০০ বছরে), ত্রেতা যুগ (১২,৯৬,০০০ বছরে), দ্বাপর যুগ (৮,৬৪,০০০ বছরে) ও কলিযুগ (৪,৩২,০০০ বছরে) অর্থভটের মতে এক মহাযুগের দিনসংখ্যা ১৫৭,৭৯,১৭,৮০০। ইহাকে ৪৩,২০,০০০ দিয়ে ভাগ করলে অর্থভটের পূর্বোক্ত বর্ধমান পাওয়া যায়।

প্রাচীন হিন্দুরা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত কালকে চারিটি ‘যাম’ বা ‘প্রহরে’ ভাগ করত এবং রাত্র ভাগকেও অনুরূপ ভাগে বিভক্ত করত। অষ্টপ্রহর বা যামে ২৪ ঘন্টার এক অহোরাত্র। দণ্ড যন্ত্রের বা নোমনের সাহায্যে আর একটি বিকল্প বিভাগ প্রচলিত ছিল। ১ মুহূর্ত x দিবাকাল, অনুরূপভাবে রাত্রির ১ মুহূর্ত হত x রাত্রকাল। (বিশ্বকোষের ভাষায় সময় বা কাল)

স্মরণ রাখা কর্তব্য যে বাসন্তবিষুব-সংক্রান্তি ও জল বিষুব সংক্রান্তি ভিন্ন বৎসরের অন্য কোনও দিনে ‘দিন-রাত্রি’ সমপরিমাণ হয় না; এজন্য দিবাভাগের একটি যাম বা মুহূর্ত রাত্রভাগের যাম বা মুহূর্তের সমপরিমাণ নয়/বাসন্ত বিষুব ও জলবিষুব দিবসদ্বয়ে প্রহরদ্দির কাল-পরিমাণ নিম্নরূপ

বেদাঙ্গজ্যোতিষের কালে এরূপ অহোরাত্র বিভাগ প্রচলিত ছিল; কিন্তু পরবর্তী সিদ্ধান্তজ্যোতিষের কালে (৩০০-১২০০ খৃ:) কালবিভাগ নিম্নপ্রকার ছিল

অহোরাত্র বা সূর্যোদয় হতে সূর্যোদয় কাল ৬০টি দণ্ডে বা ঘটিকায় বিভক্ত; প্রত্যেক দণ্ডে ৬০টি পল এবং প্রতি পলে ৬০টি বিপল । অতএব ১ দিবস = ৬০ দণ্ড। ৩৬০০ পল ২১৬০০০ বিপল এবং পলে = ৪ সেকেন্ড = ১ ‘প্রান’

বিশ্বকোষের ভাষায় সময় বা কালের হিসাব

২.৫ দণ্ডে১ ঘন্টা বা হোরা = ৬০ মিনিট
৭.৫ দণ্ড১ প্রহর = ৩ ঘন্টা
৮ প্রহরে বা ৬০ দত্তে১ দিবারাত্র = ২৪ ঘন্টা
৭ দিনে১ সপ্তাহ
১৫ দিনে১ পক্ষ
২ পক্ষে১ মাস = ৩০ দিনে
২ মাস১ ঋতু
৬ ঋতুতে১ বৎসর
২ অয়নে১ বৎসর
৩৬৫ দিনে১ বৎসর
১২ বৎসরে১ যুগ
৭১ যুগ বা ৮৫২ বছরে১ মন্বন্তর = ১ মনুর কাল
১৪ মন্বন্তরে বা ১১,৯২৮ বছরে১ কল্প = ১০০০ মহাযুগ

হিন্দুদের মতে সময়কাল (বিশ্বকোষের ভাষায় সময় বা কাল)

হিন্দু মতে, বর্তমানে ৭ম মনুর কাল চলছে, এর ২৮ মহাযুগের তিন যুগ-সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর শেষ হয়ে কলির যুগ চলছে। ১৩৯৫ বাংলা সনের ১লা বৈশাখে কলির ৫০৯০ কল্যব্দ শুরু হয়েছে।

হিন্দু জ্যোতিষশাস্ত্রে মহাযুগ অপেক্ষাও বৃহত্তর যুগ কল্পিত হয়েছে। সৃষ্টিকর্তা ব্ৰহ্মা এক এক করে সৃষ্টি করে থাকেন। ব্রহ্মার ১ দিন হচ্ছে ১ কল্প।

৪ যুগ মিলে হয় ১ মহাযুগ। হিন্দুদের হিসেবে ৪,৩২,০০০-৫,০৯০ = ৪,২৬,৯১০ বছর পরে সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যাবে, আবার যুগ পরস্পরায় হাজার বার যখন ঘুরে এ চক্র শেষ হবে তখনই ব্রহ্মার হবে ১ দিন বা ৪৩২ কোটি বছর। মহাবিশ্ব ধ্বংস করবেন ব্রহ্মা এবং বিশ্রাম নেবেন ১ রাত্র অর্থাৎ আরও ৪৩২ কোটি বছর।

পরদিন জেগে আবার সৃষ্টিকার্যে মন দেবেন। এভাবে যাবে ১০০ বছর-আমাদের হিসেবে ৩১১ ট্রিলিয়ন ৪০ বিলিয়ন বৎসর। স্মর্তব্য, ১০০ কোটিতে ১ বিলিয়ন এবং ১০০০ বিলিয়নে হয় ১ ট্রিলিয়ন।

ব্রহ্মার রাজত্ব (বিশ্বকোষের ভাষায় সময় বা কাল)

১০০ বছর পরে এ ব্রহ্মার মৃত্যু হবে। ব্রহ্মার রাজত্ব শেষ, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড ধ্বংস হয়ে যাবে । আবার সৃষ্টি, আবার ধ্বংস, অসীম মহাকালের বুকে এ খেলা চলছে অবিরত । কিছুই স্থায়ী নয়, স্মৃতিরা কেবল ঘুরে ফিরে আসে আর হাসি-কান্নায় জল পড়ে, পাতা নড়ে। আকাশের তারকারাও সবাই একদিন অলখে যায় গো ঝরে।

তিব্বতের লামাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কানতিয়া, তানতিয়াতে লেখা আছে দেবতাদের রাজত্বকালের হিসাব। প্রথম স্বর্গে পৃথিবীর ৫০ বৎসরের সমান হচ্ছে ১ দিন ১ রাত। এরকম ৫০০ বছর এখানে বেচে থাকার পর (আমাদের হিসেবে ৯০ লাখ বছর) ২য় স্বর্গে উন্নীত হবেন ! সেখানে পৃথিবীর ১০০ বৎসর হচ্ছে ১ দিন রাত্রির সমান।

ব্রহ্মার রাজত্ব (বিশ্বকোষের ভাষায় সময় বা কাল)

এ স্বর্গে ১০০০ বছর বাঁচবার পর (মানুষের ৩ কোটি ষাট লক্ষ বৎসর) তৃতীয় স্বর্গে যাবেন । ওখানে ২০০ বছর সমান ১ দিবারাত্রি। (বিশ্বকোষের ভাষায় সময় বা কাল)

২০০০ দেববর্ষ বাঁচার পর (১৪ কোটি ৪০ লাখ মানববর্ষ) চতুর্থ স্বর্গে ৪০০ বছর এবং ৪০০০ দেববর্ষ (৫৭ কোটি ৬০ লাখ মানববর্ষ) অতিক্রম করার পর পঞ্চম স্বর্গে ৮০০ বছর সমান ১ দিবারাত্র হিসেবে ১০,০০০ দেববর্ষ (২ শত ৩০ কোটি ৪০ লাখ মানববর্ষ) এবং সবশেষে ১৬০০ বছরে ১ দিবারাত্র হিসেবে ১৬০০০ দেববর্ষ সমান ৯ শত ২১ কোটি ৬০ লাখ মানববর্ষ বাঁচবেন তারা।

এ ধরণের হিসেব দেখলে আমাদের ক্ষুদ্রতাই প্রতীয়মান হয়। ১০০ বছরের মানবজীবন মাত্র ১ মুহূর্তের বলে মনে হয় ৷

প্রাচীন সভ্য মানুষের কাল পরিমাপক যন্ত্র

প্রাচীন সভ্য মানুষের কাল পরিমাপক যন্ত্র ছিল দণ্ডযন্ত্র (নোমন), সূর্যঘড়ি, জলঘড়ি (ক্লেপগিড্রা)। বর্তমান যুগের কালপরিমাপক যন্ত্রগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য :

  • ১. ক্লকঘড়ি বা হাতঘড়ি
  • ২. ক্রনোমিটার
  • ৩. স্টপওয়াচ
  • ৪. কোয়ার্টজ ঘড়ি
  • ৫. অ্যামোনিয়া ক্লক
  • ৬. আণবিক ঘড়ি
  • ৭. বৈদ্যুতিক ঘড়ি

এ সম্পর্কে পরে আমরা আলোকপাত করব। ভূতাত্ত্বিক সময় জানতে হলে ইউরোনিয়াম, থোরিয়াম প্রভৃতি তেজষ্ক্রিয় মৌলের ক্ষয়ের হার নির্ণয় করে সময় নির্ধারণ করা যায় । এখন দেখা যাক দার্শনিকরা তাদের নিরাসক্ত নির্বিকার ভাব নিয়ে সময়কে কিভাবে দেখেন?

বিভিন্ন দার্শনিক মত ও সময়

বিভিন্ন দার্শনিক মতে কাল সম্বন্ধে বিভিন্ন ধারণা দেখা যায় । ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনে অনাদি ও অনন্ত মহাকাল নবদ্রব্যের অন্যতম।

এই মহাকালের প্রত্যক্ষ্য হয় না। আমরা অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রভৃতি শব্দ যথাযোগ্যভাবে ব্যবহার করে থাকি ৷ এই সকল শব্দ প্রয়োগের অসাধারণ কারণ রূপে মহাকাল অনুমিত হয়ে থাকে। (বিশ্বকোষের ভাষায় সময় বা কাল)

কোনও ক্রিয়াদ্বারা অবিচ্ছিন্ন কাল খণ্ডকাল নামে অভিহিত। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত, পূর্বকালীন, পরকালীন প্রভৃতি বিশেষকগুলি কাল বুঝাতে প্রযোজ্য মহাকালে নহে।

সাংখ্যমতে কাল বা সময়

সাংখ্যমতে, মহাকাল বলে কিছু নেই। তথাপি প্রকৃতির সকল পদার্থ সম্বন্ধেই অতীত, বর্তমান শব্দগুলি ঠিকভাবে প্রয়োগ করা যায়।

এ সকল শব্দ দ্বারা প্রাকৃতিক পদার্থসমূহের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থা বুঝতে হবে। সুতরাং সাংখ্যমতে কাল হচ্ছে পদার্থের অবস্থা মাত্র ! তথাপি এ অবস্থা বস্তুর একটি সত্য ধর্ম।

মায়াবাদী শংকর মতে কাল বা সময়

মায়াবাদী শংকর কালকে ঈশ্বর সৃষ্ট বলেছেন। কিন্তু যেহেতু তা সৃষ্ট পদার্থ, অতএব নিশ্চয়ই খণ্ডকাল, অনাদি মহাকাল নহে। কোনও কোনও মায়াবাদী মহাকালের অস্তিত্ব স্বীকার করলেও তাকে অবিদ্যারই নামান্তর বলে মনে করেন।

কেহ কেহ আবার একে ব্রহ্ম ও অবিদ্যার অনাদি সম্বন্ধরূপে গণ্য করেন। সকল মায়াবাদীই কালকে জগতের ন্যায় মিথ্যা অবভাস মাত্র মনে করেন।

কালের বাস্তবতা সম্বন্ধে মায়াবাদের যে মত, তার সহিত পাশ্চাত্য দার্শনিক কান্ট ও হেগেলের মতের সাদৃশ্য আছে। তাদের মতে, কালের কোনও পারমার্থিক সত্তা নেই । কান্ট মনে করেন, কাল হচ্ছে ইন্দ্রিয়-সংবেদন-শক্তিরই একটি স্বকীয় আকার।

রূপ-রসাদি পদার্থ যখন কোনও জ্ঞাতার ইন্দ্রিয় দ্বারা গৃহীত হয়

তখন জ্ঞাতা হতে ওদের উপর এই কালিক আকার আরোপিত হয়ে থাকে। সুতরাং তার মতে কালের জ্ঞাতুনিরপেক্ষ বাস্তব সত্যতা নেই।

ইংরেজ দার্শনিক আলেক্সান্ডার কালকে পারমার্থিক সত্য পদার্থ বলে স্বীকার করেছেন। তিনি কালকে দেশ হতে পৃথক করে দেখেন নি। তার মতে, দেশ ও কাল একই পদার্থের দুদিক এবং ঐ পদার্থকে তিনি দেশ-কাল নামে অভিহিত করেছেন।

এই দেশ-কাল হচ্ছে চেতন ও অচেতন সমগ্র জগতের প্রকৃতি বা মূল উপাদান । প্রাচ্য কিংবা পাশ্চাত্য অপর কোনও দর্শনেই সম্ভবত: কালকে এতখানি প্রাধান্য দেয়া হয়নি।

আইনস্টাইন এর মতে সময় বা কাল

আইনস্টাইন কালকে দেশের চতুর্থ মাত্রা বলে মনে করেন । কাল দেশ সাপেক্ষ । স্থান থাকলে কালও থাকবে। স্থান বা দেশ ধ্বংস হলে কালের অস্তিত্ব নিরর্থক। অবশ্য এটা ব্যাপক অর্থেই বুঝায়। এ মতে নিরপেক্ষ সমকালীনতা বলে কিছু নেই। দ্রষ্টারা পরিপ্রেক্ষিত বা ফ্রেম এর রেফারেন্স উল্লেখ না করলে বিভিন্ন ঘটনা সমকালীন কিনা তা অনির্ণেয়।

ফরাসী দার্শনিক ব্যার্গস কালকে সদ্বস্তু বলে স্বীকার করেন। কিন্তু তিনি কালের সাপেক্ষতাবাদ মানেন না । কাল যে দেশেরই একটি দিক, তাও তিনি অস্বীকার করেছেন। কালের প্রকৃত বিরূপ হচ্ছে সাক্ষাৎ অনুভূতিতে উপলব্দ নিত্য-সৃজনশীল অবিচ্ছিন্ন গতিমত্তা ।

ঘটনার ভিতরে থেকে সময়কে দেখার এক দৃষ্টিভঙ্গী

আর বাইরে থেকে সময়কে অবলোকন করা বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় দেয় । দ্বিতীয় মতামতটি হচ্ছে মায়াবাদীদের বা ‘ফিলসফারস অব দ্যা মেনিফোল্ড’। প্রথম দলের অনুসারীদেরকে বলা হয় ‘প্রসেস ফিলসফারস’। তারা ভবিষ্যতকে অনির্দিষ্ট, অতীতকে অপরিবর্তনীয় বলে মনে করেন। দ্বিতীয় দলের মতে ভবিষ্যতকেও পরিবর্তন করা যায় না অতীতের মতই ।

মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করেই মানুষ সময়কে উপলব্ধি করতে শিখেছে সভ্যতার আদি যুগ থেকেই। সবকিছুরই যে শেষ আছে, মানুষ যে অমর নয় এটা সে বুঝার পর থেকেই তার চেতনা জগতে ঘটে গেছে এক বিপ্লব। সময় সম্পর্কে ধারণা মৃত্যুর সঙ্গে ধ্বংসের সঙ্গে জড়িত।

জরোস্ত্রানিজম, জুডাইজম, খৃষ্টধর্মে এবং ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করা

জরোস্ত্রানিজম, জুডাইজম, খৃষ্টধর্মে এবং ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করা হয় মৃত্যুর সাথে সাথেই সবকিছু শেষ হয়ে যায় না —– সামনে রয়েছে পুনরুত্থান এবং চিরকালের জন্য স্বস্ব বাসস্থানে গমন ।

অপরদিকে বৌদ্ধ, অরফিক, পিথাগোরাস, প্ল্যাটোবাদী ও হিন্দুরা মনে করে মানুষের পুর্নজন্ম রয়েছে। চিরতরে আত্মার মুক্তি সাধন নির্বান না হওয়া পর্যন্ত অসংখ্যবার (হাজার হাজার) জন্ম নিতে হবে বিভিন্ন প্রাণী, উদ্ভিদ রূপে।

নবজন্মে কিছুই মনে থাকে না স্মরণ শক্তির দুর্বলতার জন্য

এ দলের মতে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের ধ্বংস হবার পর আবার শুরু হবে আমাদেরি নিয়ে। আমরা শত শত কোটি বছর আগে যে যেভাবে জীবনযাপন করেছি নতুন প্রজন্মেও তেমনি দিন কাটাব। অর্থাৎ ভাগ্য একই রকম থাকবে। একটা চেইনের মত চলবে।

দুপক্ষেই যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে-তবে কে যে ঠিক তার প্রমাণ কোনদিনই মিলবে না । মহাকালের বুকে রয়ে গেছে তার জবাব। মানুষের ক্ষুদ্র ধারণা শক্তি দিয়ে এ প্রশ্নের জবাব গত ৭ হাজার বছরেও যাওয়া যায়নি এবং সামনেও পাওয়া যাবে না। কারণ মৃত্যুর পর কেউ আর কোনদিন ফিরে আসেনি জানাতে যে মৃত্যু পরবর্তী জগৎ বলতে সত্যিই কিছু আছে কিনা ।

তাই আমাদের সব আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকে মহাবিশ্বের সৃষ্টির মুহূর্ত থেকে ধ্বংস হওয়া পর্যন্ত সময়টাকে ঘিরে। সময় অতীত থেকে ভবিষ্যতের গর্ভে চলতে থাকে এই একমুখী চিন্তাবিদদের এবং দ্বিতীয় দলের চক্রাকারে ফের শুরুর মতাবলম্বীদের মাঝের দ্বন্ধ নিয়েই বিকশিত হচ্ছে দর্শন, বিজ্ঞান।

মহাজাগতিক সময় বিশ্বকোষের ভাষায় সময় বা কাল

চীনামতে স্ত্রী প্রকৃতি ‘ঈন’ ও পুরুষ প্রকৃতির ‘ইয়াং’ নিয়ে মহাজাগতিক সময় বয়ে চলছে। পজিটিভ, নেগেটিভ, প্রোটন, ইলেকট্রনের এই ধারণা নিয়েই আমাদের জ্ঞান বিজ্ঞানের রাজত্ব।

বিভিন্ন জাতি বিভিন্ন যুগে সময় সম্পর্কে বেশ জ্ঞান লাভ করেছে। মুসলিম দার্শনিক ইবনে খলদুন চতুর্দশ শতাব্দীতেই ‘চক্রাকারে পুনরাবর্তন’ দর্শনে আস্থা প্রকাশ করেন । মিশরের ফারাওরা পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে মমী করত নিজেদের দেহকে। সময়কে ধরে রাখার এই প্রয়াস ছিল অবজ্ঞাপ্রসূত।

ভগবদ্গীতায় বলা আছে বিশ লাখ পাঁচ হাজার বছর আগে মনু নিজের পুত্র ও শিষ্য পৃথিবীর শাসনকর্তা মহারাজ ইক্ষ্বাকু-কে ‘ভগবদগীতা’ শোনান। বর্তমান মনুর রাজত্বকাল ত্রিশ কোটি তিপ্পান্ন লক্ষ বছর-

এর মধ্যে গত হয়ে গেছে ১২ কোটি চার লক্ষ বছর । মানুষের সমাজে গীতা প্রচলিত রয়েছে নাকি বিশ লাখ বছর ধরে। পাঁচ হাজার বছর আগে শেষ বারের মত ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে ‘গীতা’র ব্যাখ্যা দেন ।

হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ ‘গীতা’য় বলা আছে, বিশ্বে চুরাশি লাখ ধরণের (জীবিত প্রাণী ও উদ্ভিদ জগৎ) জীবন রয়েছে। এদের মধ্যে চার লক্ষ প্রকারের হচ্ছে মানবজীবন ।

মানুষের মৃত্যুর পর কর্মফল অনুযায়ী

এ চার লক্ষ মানব জীবনে রয়েছে বিভিন্ন ধরণের মানুষ; সভ্য, অসভ্য, আস্তিক, নাস্তিক, শ্রমিক, রাজা, উঁচু-নিচু … ইত্যাদি। মানুষের মৃত্যুর পর কর্মফল অনুযায়ী সে এক এক পশু, বৃক্ষ, পতঙ্গের রূপ ধরে জন্ম গ্রহণ করে- ভাল কাজ করলে উন্নততর জীব হিসেবে জন্মায় । অন্যথায় নিচু কুলে জন্ম অবধারিত ।

সোজা কথায় প্রত্যেককেই তার কর্মফল ভোগতে হয়। এমনি করে চুরাশি লাখ বার জন্ম নেবার পর তার জীবচক্রের হাত থেকে মুক্তি লাভ ঘটতে পারে যদি ঐ জন্মে কোন সুকৃতি তার থাকে ।

সাধু জীবনযাপন করলে পর বা পরের জন্য জীবন দিলে পরই কেবল আত্মার মুক্তি ঘটবে । আত্মা পরমাত্মার সঙ্গে মিলনের উদ্দেশ্যে উর্ধ্বলোকে পাড়ি জমাবে। সেখানেও রয়েছে ৭টি লোক (আবাসস্থল, গ্রহ বিশেষ)। সর্বোপরি রয়েছে ব্রহ্মলোক।

হিন্দুশাস্ত্রে এবং তিব্বতীয়দের বিশ্বকোষের ভাষায় সময় বা কাল

হিন্দুশাস্ত্রে এবং তিব্বতীয়দের “মৃতের পুস্তকে” আমরা পুনর্জন্মে আস্থা দেখতে পাই । বৌদ্ধমতে জীব পুনঃপুনঃ জন্মগ্রহণ করে এবং জন্মে জন্মে রোগ, শোক ও নানা রকমের দুঃখ ভোগ করে। আরও খারাপ হ’ল—

মানুষ এ জন্মে ভাল কাজ করলে মহাপুরুষ বা দেবতা হয়ে পরজন্মে জন্মগ্রহণ করে এবং এ জন্মে মন্দ কাজ করলে নিকৃষ্ট ধরণের মানুষ কিংবা নিকৃষ্ট প্রাণী যথা : কাক, শিয়াল, কুকুর, গাধা ইত্যাদি হয়ে জন্মে।

বৌদ্ধদের অবশ্য ভাল কর্ম করলে আর জন্ম নিতে হয় না । অর্থাৎ তারা নির্বান লাভ করে। ভারতের বিখ্যাত দার্শনিক রাষ্ট্রপতি সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ বলেন, “পুর্নজন্ম প্রকৃতির বিধান। বিভিন্ন ধরণের জীবনের বিকাশের সঙ্গে পুর্নজন্মের সংযোগ রয়েছে।”

প্রিয় পাঠক, GulfHive এর বিশ্বকোষের ভাষায় সময় বা কাল আর্টিকেলটি শুধুমাত্র আপনাদের সময়ের বিচিত্র কাহিনী ও মহাকালের অজানা রহস্য তথ্য দেওয়ার জন্য প্রকাশিত হয়েছে। এই পোস্ট এর বিষয়ে আপনার কোনো অভিযোগ বা পরামর্শ থাকলে নিচের বাটনে ক্লিক করে কমেন্ট করুন অথবা আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন। আপনি চাইলে ফেসবুকে আমাদের সাথে কানেক্ট থাকতে পারেন।

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *