Sign In

সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ

সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ

ইসলামে মহানবী সাল্লাম এর পবিত্র মিরাজের ঘটনা রহস্যময়। সময়ের পরিক্রমায় সাথে এর সম্পর্ক বিদ্যমান। আজকে আমরা জানবো সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ নিয়ে। এ আর্টিকেল এর মাধ্যমে আপনি ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ মিরাজের সাথে সময়ের গভীর সম্পর্ক উপলব্ধি করতে পারবেন এবং এই সম্পর্কে আরো জানতে পারবেন।

গত পর্বে আমরা জেনেছি বাংলা সনের জন্মকথা নিয়ে। আপনারা যারা বাংলা ক্যালেন্ডার বা বাংলা সন নিয়ে আগ্রহী তারা এটা পড়ে নিতে পারেন।

কুরআনে মি’রাজ প্রসঙ্গ

সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ
কুরআনে মি’রাজ প্রসঙ্গ

আরবী শব্দ ‘মি’রাজ-এর অর্থ হচ্ছে সিঁড়ি বা সোপান, ঊর্ধ্বগমন বা আরোহণ। মহানবী (সা.) কর্তৃক মদীনা হিজরতের এক বছর পূর্বে ৬২২ খৃষ্টাব্দে রজব মাসের সাতাশ তারিখের রাতে এই মি’রাজ সম্পন্ন হয়েছিল। মি’রাজ হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নবৃওয়াত ও রিসালতের এক শ্রেষ্ঠতম অলৌকিক নিদর্শন।

এ প্রসঙ্গে কুরআনে বর্ণিত আছে-

পবিত্র ও মহিমাময় তিনি যিনি তাঁর বান্দাকে তাঁর নিদর্শন দেখাবার জন্য রাত্রে সফর করিয়েছিলেন মসজিদুল-হারাম থেকে মসজিদুল-আকসায় যেখানকার পরিবেশ আমি করেছিলাম বরকতময়, তাকে আমার নিদর্শন দেখাবার জন্য; তিনিই শ্রোতা সর্বদ্রষ্টা।

সূরা বনী-ইসরাঈল : ১

স্মরণ কর, আমি তোমাকে বলেছিলাম, তোমার প্রতিপালক মানুষকে ঘিরে রয়েছেন। আমি যে দৃশ্য তোমাকে (মি’রাজে দেখিয়েছি তা এবং কুরআনে উল্লিখিত অভিশপ্ত বৃক্ষটি কেবল মানুষের পরীক্ষার জন্য। আমি তাদের ভয় দেখাই, কিন্তু তা তাদের উগ্র অবাধ্যতাই বৃদ্ধি করে।

সূরা বনী-ইসরাঈল : ৬০

এই পবিত্র আয়াতদ্বয়ে হযরত রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর মি’রাজ’ বা অলৌকিক পরিভ্রমণের প্রসঙ্গ বর্ণিত হয়েছে। মহানবী (সা.) মি’রাজের রাত্রে মহাশূন্যলোকে ভ্রমণে গিয়েছিলেন।

মিরাজে রাসূল সা: যা দেখেছেন (সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ)

সেখানে রসূলে করীম বেহেশত ও দোযখ দেখেছিলেন, রব্বুল আলামীন আল্লাহর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল। তাছাড়া আঠারো হাজার আলম বা জগত তথা সমগ্র সৃষ্টিলোকের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে তিনি যখন পৃথিবীতে মক্কা নগরীতে স্বীয় গৃহে ফিরে এসেছিলেন, তখন তাঁর শয়নকক্ষের বিছানায় তাঁর দেহের উষ্ণতা বিদ্যমান ছিল এবং তিনি দেখলেন যে, ওযূর অবশিষ্ট পানিটুকু তখনও গড়িয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন হাদীসে এ সম্পর্কে বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে।

বর্ণিত আছে, মিরাজে তিনি তিন লক্ষ বছরের পথ পরিভ্রমণ করেছিলেন এবং তাতে জাগতিক সাতাশ বছর সমপরিমাণ সময় ব্যয়িত হয়েছিল।

অথচ অযূর পানি তখনও গড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীর ঘড়িতে ৬০ সেকেন্ডেরও কম সময় এতে লেগেছে।

এক কথায় বলা চলে মহানবী (সা.) এক মিনিটের মধ্যে সাত আকাশ সাত জমিন ভ্রমণ করে বিশ্ব জগতের সব রহস্য দেখে নিয়েছিলেন;

বহু নবী-রসূলের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল, তিনি নবী ও ফেরেশতাদের নামাযে ইমামতি করেছিলেন।

বেহেশত ও দোযখে তাদের অধিবাসীদেরকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন, মহান আল্লাহর সঙ্গে কথা বলেছিলেন এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের বিধান নিয়ে বুরাক ও রাফরাফে করে পৃথিবীতে ফিরে এসেছিলেন।

মিরাজে রাসূল সা: যা দেখেছেন

রসূলুল্লাহ (সা.) মি’রাজ শরীফে সশরীরেই গিয়েছিলেন

এই পরিভ্রমণ সম্বন্ধে তফসীরকার, ঐতিহাসিক মুহাদ্দিস ও জীবনচরিত লেখকগণের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। এক শ্রেণীর ভাববাদী সূফীর অভিমত হচ্ছে, রসূলুল্লাহ (সা.) মি’রাজ শরীফে সশরীরেই গিয়েছিলেন।

অপর একদল সূফী ও দার্শনিক অভিমত প্রকাশ করেছেন, রূহানী শক্তিবলে আধ্যাত্মিকভাবে এক মুহূর্তের মধ্যে রসূলে করীম কুল- মখলুকাত সফর করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

মহানবীর অন্তর-মন যাতে ইহ-পারলৌকিক জ্ঞান-সম্পদে পরিপূর্ণ এবং অদৃশ্য জগত সম্বন্ধে পূর্ণবিশ্বাসী হয়, সে উদ্দেশ্যেই সর্বশক্তিমান রব্বুল আলামীন আল্লাহ্তা’আলা তাঁর অনন্ত রহস্যের মধ্যে বেহেশ্ত, দোযখ ও নভোমণ্ডলের বিভিন্ন স্তর ও অদৃশ্য জগতের রহস্যাবলী প্রত্যক্ষরূপে প্রদর্শন করার জন্য হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে এই অলৌকিক পরিভ্রমণ করিয়েছিলেন।

বিশ্বনবী পরদিন যখন এই ভ্রমণ-বৃত্তান্ত বর্ণনা করেন, তখন বিশ্বাসী মুসলমানেরা নিঃসন্দেহে তা বিশ্বাস করেছিলেন। পক্ষান্তরে অবিশ্বাসী কুরাইশরা অবিশ্বাস করে উক্ত পরিভ্রমণের সত্যত।

বায়তুল মুকাদ্দাসের অবস্থিতি ও স্বরূপ

সপ্রমাণ করবার জন্য বায়তুল মুকাদ্দাসের অবস্থিতি ও স্বরূপ, মক্কা ও বায়তুল-মুকাদ্দাসের মধ্যবর্তী পথে বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত ‘ব্যবসায়ী যাত্রিগণের অবস্থা এবং অন্যান্য বিষয় সম্বন্ধে যে সকল প্রশ্ন করেছিল, যে সমস্ত বিষয় সম্বন্ধে জানতে চেয়েছিল, রসূলুল্লাহ (সা.) তাঁদের প্রতিটি প্রশ্ন ও বিষয়ের যথাযথ উত্তর প্রদান পূর্বক তাদেরকে বিস্মিত ও চমৎকৃত করে দিয়েছিলেন।

বায়তুল মুকাদ্দাসের অবস্থিতি ও স্বরূপ
বায়তুল মুকাদ্দাস

সহীহ ‘মুসলিম’ ও ‘মাআলিমুত তানযীল’ এবং অন্যান্য হাদীসসমূহে মি’রাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা রয়েছে। তাছাড়া যুগে যুগে মুসলিম মনীষীরা মি’রাজের দার্শনিক দিক নিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন।

ইমাম গাযালী, ইবনে সীনা প্রমুখ চিন্তাবিদদের মি’রাজ সম্পর্কীয় গবেষণা গ্রন্থও রয়েছে। মি’রাজের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ইতালীয় কবি দান্তে ‘ডিভাইন কমেডি’ রচনা করেছিলেন আর তাঁরই অনুসরণে ইংরেজ কবি মিল্টন ‘প্যারাডাইজ লস্ট’,

জার্মান কবি গ্যেটে ‘ফাউন্ত’ ও রুশ কবি পুশকিন অ্যাঞ্জেল, প্রফেট’ ইত্যাদি বিখ্যাত রচনাকর্ম সাধন করেছিলেন। অথচ কুলাঙ্গারজাত সালমান রুশদী কুরআনের উল্টো শয়তানের কাব্য রচনা করে সারা মুসলিম জগতে ধিকৃত হয়েছে।

মি’রাজ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আরও কয়েকটি আয়াত রয়েছে

এবং সে সমুন্নত গগনপ্রান্তে ছিল, অতঃপর সে নিকট হতে নিকটতর হয়েছিল; এমন কি তাদের মধ্যে দুই ধনুকের ব্যবধান ছিল অথবা আরও কম ছিল। তখন তিনি তাঁর বান্দার প্রতি যা ওহী করার তাই ওহী করেছিলেন।

তখন যা সে প্রত্যক্ষ করেছিল, তার অন্তঃকরণ তা অস্বীকার করেনি। তবে কি তোমরা তদ্বিষয়ে তার সঙ্গে বিতর্ক করবে, যা সে প্রত্যক্ষ করেছিল এবং নিশ্চয়ই সে তাঁকে আরেকবার প্রত্যক্ষ করেছিল;

প্রান্তবদরী বৃক্ষের সন্নিকটে; তারই কাছে অবস্থিত বাসোদ্যান । যখন বৃক্ষটি, আবৃত হবার তদ্দ্বারাই আবৃত ছিল, তখন তাঁর দৃষ্টি বিভ্রান্ত অথবা লক্ষ্যচ্যুত হয়নি। নিশ্চয়ই সে (মুহাম্মদ) স্বীয় প্রতিপালকের মহান নিদর্শনাবলী অবলোকন করেছিল।

সূরা নজম : ৭ -১৮

অর্থাৎ ঐ পবিত্র রজনীতে আল্লাহর সন্দর্শন ও সান্নিধ্য লাভের সময় তাঁর সাথে মহানবীর সামান্য মাত্র পার্থক্য বিদ্যমান ছিল (ধনুকের জ্যা-এর মধ্যকার দূরত্ব) এবং সেই শুভ মুহূর্তে তিনি তাঁর প্রিয়বন্ধুর আধ্যাত্মিক ও নৈতিক জীবনের পূর্ণতা সাধনের জন্য তাঁর অলৌকিক মহিমা ও অনন্ত জ্ঞান সম্বন্ধে যা কিছু বলবার বা জানাবার ছিল, তা সমস্তই স্পষ্টতর ভাষায় পরিজ্ঞাপন করেছিলেন।

সিদরাতুল মুন্তাহা

‘সিদরাতুল মুন্তাহা’র শাব্দিক অর্থ সমুচ্চ বা সমুন্নত তরু হলেও এর প্রকৃত মর্মার্থ হচ্ছে মানব-জ্ঞানের শেষ সীমা বা মানবীয় ধারণার পরিসমাপ্তি। এ স্থানেই আল্লাহ্তা’আলা হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-কে দর্শন দান করে তাঁর সাথে প্রত্যক্ষভাবে কথোপকথন করেছিলেন।

কিন্তু এ সকল অলৌকিক ব্যাপার মানব-জ্ঞান বা মানবীয় ধারণার অতীত বলেই একে সিদরাতুল মুন্তাহার সন্নিকটবর্তী ঘটনা বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ্তা’আলা একথাও বলে দিয়েছেন যে, এ সকল ব্যাপার সন্দর্শনে রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর চক্ষু বিভ্রান্ত অথবা লক্ষ্যচ্যুত হয়নি অর্থাৎ তিনি প্রত্যক্ষ দৃষ্টিতেই সমস্ত বিষয় অবলোকন করেছিলেন।

মি’রাজ নিয়ে বাদানুবাদ নিরর্থক । মি’রাজ এমনি এক বিষয় যা বাস্তব উপলব্ধি ছাড়া কারো পক্ষে হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব নয়। এর জন্য অপরিপক্ক জল্পনা-কল্পনা অথবা অভিজ্ঞতাহীন বিতর্ক ও যুক্তির অবতারণার আদৌ কোন প্রয়োজন নেই।

বিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের ধ্যান-ধারণার প্রভূত উন্নতি সাধন হয়েছে। তারই আলোকে মি’রাজের ব্যাখ্যা দেবার প্রচেষ্টার আগে আমরা ইতিহাস-বিখ্যাত একটি দার্শনিক দৃষ্টান্তের কথা উল্লেখ করব।

সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ

সিদরাতুল মুন্তাহা

মি’রাজের সূফীতাত্ত্বিক উদাহরণ ও ব্যাখ্যা

ত্রয়োদশ শতকে মি’রাজের রহস্য নিয়ে মিসরের শাসনকর্তা ১ম আয়ূবী সুলতান আল- মালিক আল আদিল (১২০০-১২১৮)-এর দ্রবারে বিতর্কের যে ঝড় উঠেছিল তার সমাধান দিয়েছিলেন বিখ্যাত সুফী সাধক ও সোহরাওয়ার্দী তরীকার প্রতিষ্ঠা হযরত শেখ শিহাবুদ্দীন আবূ হাফ্ উমর সোহরাওয়ার্দী (১১৪৫-১২৩৫)।

তিনি ছিলেন বড় পীর হযরত শেখ আব্দুল কাদির জিলানী (র.) [১০৭৭-১১৬৬/-এর মুরীদ এবং বিখ্যাত পুস্তক ‘আওয়ারিফুল মাআরিফ’ (গভীর তত্ত্বজ্ঞানের উপহার)-এর রচয়িতা।

মি'রাজের সূফীতাত্ত্বিক উদাহরণ ও ব্যাখ্যা
মি’রাজের সূফীতাত্ত্বিক উদাহরণ ও ব্যাখ্যা

ইসলামী দুনিয়ায় তাসাওউফ বা দর্শনের অন্যতম পথিকৃৎ কামিল বুযুর্গ শেষ শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী সুলতানের দরবারে আসন নিয়ে ৪টি অলৌকিক ঘটনা প্রদর্শন করান।

তারপর তিনি প্রশস্ত মুখবিশিষ্ট বড়ো একটি পানি ভরা পাত্র নিয়ে আসতে হুকুম করলেন পাত্রটি সুলতানের সামনে রেখে তাঁর পাগড়ীটা খুলে ঐ পাত্রের মধ্যে মাথা ঝুঁকিয়ে কয়েক মুহূর্ত থাকতে বললেন সুলতান সূফীর আদেশ পালন করার জন্য যেই মাথা পানির পাত্রের মধ্যে ঝুঁকিয়ে দিলেন, এমনি সময় এক আজব কাণ্ড ঘটে গেল!

সুলতানের মনে হল

তিনি এক নির্জন সমুদ্রতীরে এসে আছড়ে পড়েছেন ঝড় ও ঢেউয়ের আঘাতে। নিরুপায় সুলতান সমুদ্রতীর ধরে এগিয়ে গিয়ে কিছু কাঠুরিয়ার দেখা পেলেন যারা তাঁকে কিছু পরার কাপড় উপহার দিল । অনেক দূর চলার পর সুলতান এক শহরে গিয়ে হাজির হলেন এবং এখানে এক কামারের দেখা পেলেন।

কামার সুলতানের দুর্ভাগ্যের কথা শুনে পরামর্শ দিল ঐ শহরের হাম্মামখানায় যাবার জন্য। গোসলখানায় অবিবাহিত মেয়েরা আসে পছন্দমত কোন বিদেশীকে বিয়ে করার জন্য যদি সে রাজী থাকে। এটা ছিল ঐ দেশের একটি অদ্ভুত নিয়ম।

সুলতান কামারের কথামত শহরের একটা হাম্মামখানার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন এবং এক সুন্দরীকে পেলেন যে তাঁর স্ত্রী হল। সুলতান নববিবাহিত বধূকে নিয়ে সেই শহরে সুখেই দিন কাটাতে থাকেন।

ক্রমে তাঁর মন থেকে অতীত জীবনের স্মৃতি মুছে গেল। দেখতে দেখতে সাতটি বছর কেটে গেল। সুলতানের নতুন স্ত্রীর গর্ভে সাতটি ছেলেমেয়ের জন্ম হল। বসে খেয়ে স্ত্রীর পৈত্রিক সম্পত্তি ও গচ্ছিত টাকা-পয়সা একদিন শেষ হয়ে গেল।

এখন থেকে সন্তানদের ভরণ-পোষণের জন্য সুলতানকে কাজকর্মের চেষ্টা করতে হবে।

সুলতানের স্ত্রী বললেন

কোন কাজ জানা না থাকাতে সুলতান বাজারে গিয়ে কুলির কাজ শুরু করলেন। তিনি খুব কমই উপার্জন করতে পারলেন। পরদিন আবার তিনি ঝুড়ি নিয়ে বের হলেন। এবং রাস্তা দিয়ে চলতে গিয়ে তাঁর চোখের সামনে অতীত জীবনের স্মৃতি ভেসে উঠল। মনে পড়ল, সেই সমুদ্র-সৈকতের কথা।

সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ

সুলতান সেই স্থানটিতে এসে পৌঁছলেন

ভারাক্রান্ত মনে তিনি নামায আদায়ের জন্য ওযূ করতে সেই সমুদ্রে নামলেন ঠিক সেই মুহূর্তে তিনি যেন নতুন করে সম্বিত ফিরে পেলেন।

মাথা উঁচু করেই সুলতান দেখতে পেলেন—তিনি মিসরেই নিজের দরবারে পানির পাত্রের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।

আপনার জাদুগিরির জন্য আমাকে সাত বছর নির্বাসনদণ্ড ভোগ করতে হল । উঃ সাত সাতটা বছর—একটা পরিবার লাভ—বাজারে কুলিগিরির কাজ!

সুলতান গর্জে উঠলেন

সূফী সাধক ও সমাগত পারিষদবর্গ এক বাক্যে জানালেন, “কোথায় সাত বছর? আপনি মাত্র এক পলক পানির পাত্রের ওপর ঝুঁকেছিলেন!” কিন্তু সুলতান দরবারে কারো কথাই বিশ্বাস করলেন না। অথচ সত্য হল এই যে, একটি মাত্র মুহূর্তের জন্য সুলতান পানির পাত্রে মাথা ঝুঁকিয়ে দিয়েছিলেন আর সেই এক মুহূর্ত সময়ের মধ্যে তিনি তাঁর জীবনের সাত সাতটি বছর পার করে এসেছিলেন।

সুলতান সেই স্থানটিতে এসে পৌঁছলেন
সুলতান সেই স্থানটিতে এসে পৌঁছলেন

আসল ঘটনা কি ঘটেছে সেটা বড় কথা নয়

যেটা গুরুত্ববহ, তা হল, উপাদান। আত্মশক্তিকে কাজে লাগিয় সক্রিয় করে তুলে বহু ঘটনা ঘটানো যায়। আত্মশক্তির উদ্বোধনের মাধ্যমে সাধকগণ জড়দেহসহ ইথারীয় অদৃশ্যলোকের তরঙ্গমালায় মিলে যেতে সক্ষম হন নিজেকে অদৃশ্য করে দিয়ে।

আল্লাহ্র রসূলের ক্ষেত্রে ঠিক এমনটি ঘটেছিল। মি’রাজ থেকে ফিরে এসে রসূলের বিছানা গরমই দেখা গিয়েছিল আর তাঁর ওযূর পানি তখনও গড়িয়ে যাচ্ছিল।

রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর মি’রাজ পরিভ্রমণ কি সশরীরে ঘটেছিল, না আত্মিকভাবে ঘটেছিল এ প্রশ্নের জবাব দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন শেখ শিহাবুদ্দীন।

তিনি মিসরের সুলতানের এক মুহূর্তকালের নির্বাসিত জীবনের মাঝে সাত বছরের চলমান ঘটনার বাস্তব উপলব্ধির মধ্য দিয়ে সুলতানকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, আমাদের এই জড়- জগতের ত্রিমাত্রিক প্রেক্ষাপটে এক মুহূর্তকালের মধ্যে সাত বছর তথা হাজার বছরের

সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ

ঘটনা বিধৃত হতে পারে

মনের জগত বা আধ্যাত্মিক জগতের ঘটনাস্রোত এমনই দ্রুত গতিতে সম্পন্ন হতে পারে যে, ত্রিমাত্রিক জড় জগতে সেই একই ঘটনা বাস্তবায়িত হতে লক্ষ কোটি বছরের প্রয়োজন হতে পারে।

বিজ্ঞানের জগতে আমরা জানি প্রাকৃতিক উপায়ে পেট্রোল বা হীরা জন্ম নিতে কোটি কোটি বছর লেগে যায়, অথচ গবেষণাগারে নির্দিষ্ট পরিমাণ চাপ-তাপ ও অন্যান্য উপাদানের সমন্বয়ে মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই তা সম্পন্ন করা যায়।

চেতনার বাইরে ইন্দ্রিয়জগতে অনুভূতিকে সজীব রাখা হলে তর পরিণতিতে ইন্দ্রিয়জগতের ক্রিয়াকর্ম চলতে পারে, তা না হলে সুলতান দরবারে থাকা অবস্থাতেই কি করে সাত বছরকাল ধরে বৈবাহিক জীবনে সুখ-দুঃখ, হাসিকান্নায় এমনভাবে মিশে যেতে পেরেছিলেন?

তা ছাড়া তিনি চেতনার জগতে ফিরে এসে ঐ ঘটনার বিষয় স্মরণ করলেন? শেখ শিহাবুদ্দীন এভাবে প্রমাণ করেছিলেন যে, রসূলে করীমের মি’রাজ সশরীরেই সম্পন্ন হয়েছিল।

সুফী দার্শনিকেরা বলেন, আল্লাহর অদৃশ্যমান্যতার গুণ বা শক্তির উদ্বোধন দ্বারা আত্মশক্তির নিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনকারী যে কোন ব্যক্তি যে কোন মুহূর্তে অদৃশ্যলোকে আত্মগোপন করতে পারেন এবং চোখের পলকে আল্লাহ্র শক্তিতে শক্তিমান হয়ে লক্ষ কোটি মাইল দূরে চলে যেতে সক্ষম হতে পারেন।

প্রকৃতপক্ষে রূহানী শক্তির অপরিসীম ক্ষমতা সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ নেই । বর্তমান বিজ্ঞান ও মানুষের মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা করে বিরাট সম্ভাবনা প্রত্যক্ষ করে বিস্মিত হচ্ছে। আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এমন দিন আসবে যখন মানুষকে জড়দেহ থেকে মুহূর্তে অনুসমষ্টিতে রূপান্তরিত করে দূর-দূরান্তে প্রেরণ করা সম্ভব হবে।

সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ

অধিবিদ্যা (metaphysics) ও পদার্থবিদ্যার আলোকে মি’রাজ

মিরাজ সংঘটিত হবার ব্যাপারে মানবমনে দুটি প্রশ্ন এসে দাঁড়ায়, যথা: স্থূল দেহে মহাজাগতিক ভ্রমণ সম্ভব কিনা, দ্বিতীয়ত পৃথিবীর এক মুহূর্তে মহাজাগতিক হাজার বছর তথা সাতাশ বছরে কালপ্রসরণ নাকি কালসঙ্কোচন ঘটেছিল?

বিজ্ঞান বলে স্থূলদেহে আন্তঃগ্যালাকটিক ভ্রমণ কালপ্রসরণের বদৌলতে সম্ভব। যেহেতু বিজ্ঞান এখনও সব রহস্যের জট খুলতে পারেনি, বিশ্বজগতের সৃষ্টি রহস্যের সব ব্যাখ্যা দিতে পারেনি, তাই দার্শনিক অধিবিদ্যার সাহায্য নেয়া ছাড়া এই আলোচনা অসম্ভব ৷

অধিবিদ্যা (metaphysics) ও পদার্থবিদ্যার আলোকে মি'রাজ
অধিবিদ্যা (metaphysics) ও পদার্থবিদ্যার আলোকে মি’রাজ

বিজ্ঞান চায় শুধু প্রমাণ ! আর প্রত্যক্ষ প্রমাণ সব ব্যাপারেই দুরূহ কাজ। মহানবীর মি’রাজে বুরাক নামক বাহক ব্যবহৃত হয়েছিল। এই শব্দটির অর্থ বিদ্যুৎ।

বিদ্যুৎ তথা আলোর গতি প্রতি সেকেণ্ডে এক লক্ষ্য ছিয়াশি হাজার মাইল বা তিন লক্ষ কিলোমিটার যা সমগ্র পৃথিবীকে ৭ বার পরিভ্রমণের সমান দূরত্ব বোঝায়।

বুরাকের পরেও মি’রাজ ভ্রমণ উপলক্ষে রাফরাফ বা আরও বিশিষ্ট দ্রুতযান ব্যবহার করা হয়েছিল বলে হাদীসে বর্ণনা রয়েছে। সশরীর মি’রাজ সংগঠিত না হলে পর এই সব যানবাহনের কথা উল্লিখিত হত না।

বিশ্বন্দ্বী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে জড়দেহী মানবরূপে দেখা গেলেও প্রকৃতপক্ষে হয়ত তিনি জড়ধর্মী ছিলেন না; পদার্থের যা সার সেই জ্যোতি বা নূর দ্বারাই তাঁর দেহ মুবারক গঠিত ছিল।

সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ

কুরআনে আল্লাহ বলেন

আল্লাহর নিকট হতে এক জ্যোতি ও স্পষ্ট কিতাব তোমাদের নিকট এসেছে।

সূরা মায়িদা, আয়াত : ১৫

হাদীসে কুদসী থেকে জানা যায়, রসূল বলেছেন, “আমি আল্লাহর নূর এবং সমুদয় বস্তু আমার নূর হতে সৃষ্ট;”

তদুপরি মি’রাজের আগে মহানবীর হৃদয় বিদীর্ণ করে ফেরেশতারা তা ধৌত করে আরো কিছু প্রক্রিয়া করে পুণরায় ভরে দিয়েছিলেন। খুব সম্ভবত মহাজাগতিক ভ্রমণের জন্য হযরতের পবিত্র হৃদয়কে রিচার্জ করা হয়েছিল ব্যাটারীর মত। এ কারণেই স্থূলদেহমুবারক নিয়েও তাঁর পক্ষে মহাকাশ পরিভ্রমণ সম্ভব হতে পেরেছিল।

মানবদেহে জড় পদার্থ ছাড়াও চৈতন্য (Spirit) বা প্রাণশক্তি (Mind) রয়েছে। এই প্রাণশক্তিই চিরকাল জড়ের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে এসেছে।

প্রচণ্ড প্রাণশক্তিসম্পন্ন মানুষ তার ইচ্ছাশক্তির জোরে জড় পদার্থের ওপর প্রভাব বিস্তার করে নিয়ম-শৃঙ্খলা উল্টে দিতে পারে।

ইত্যাদিকার বিশেষ গুণের বদৌলতেই খুব সম্ভবত রসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর পক্ষে জড়দেহে মহাবিশ্বভ্রমণ সম্ভবপর হয়েছিল।

সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ

পদার্থ ও শক্তির মধ্যে কোন বিশেষ পার্থক্য নেই

একটিকে আর একটিতে রূপান্তরিত করা সম্ভব । বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইন তাঁর বিখ্যাত সূত্র E=mc2 দিয়ে এই বক্তব্য প্রমাণিত করেছেন। m বা কোন পদার্থের ভরকে যদি (দ্বিগুণ) আলোর গতি (c) দিয়ে গুণ করা যা তাহলে পাওয়া যাবে E পরিমাণ শক্তি।

প্রমাণিত হয়েছে নূর বা আলোক দ্বারা পদার্থ সৃষ্টি সম্ভব বা পদার্থকেও নূর বা আলোক-শক্তিতে রূপান্তরিত করা যেতে পারে যা পরমাণু বোমায় ঘটানো হয়। স্মর্তব্য, নূর হচ্ছে এক বিশেষ ধরনের আলো বা জ্যোতি যার রহস্য আল্লাহ্ই ভাল জানেন।
যে কোন পদার্থই অগণিত পরমাণুর সমন্বয়ে গঠিত।

পদার্থ ও শক্তির মধ্যে কোন বিশেষ পার্থক্য নেই
পদার্থ ও শক্তির মধ্যে কোন বিশেষ পার্থক্য নেই

পরমাণুগুলো আবার ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন ইত্যাদিতে বিভক্ত। এ পরমাণুকে ভেঙ্গে ফেললে তার আর পদার্থ হিসাবে অস্তিত্ব থাকে না (কোয়ার্ক)। তখন সেই পদার্থ আলো বা যে কোন প্রকার বিকিরণ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। মহাবিশ্বের যে কোন পদার্থকেই সম্পূর্ণরূপে আলো বা নূরে রূপান্তরিত করা যেতে পারে।

কুদসী হাদীস মুতাবিক বলা যায় যে

আল্লাহ নিজ নূরের একাংশ দ্বারা নূরে মহাম্মদী সৃষ্টি করেছিলেন। অর্থাৎ আল্লাহ প্রথমে এক বিপুল পরিমাণ আলো তাঁর নিজ থেকে আলাদা করেছিলেন। যদিও সে আলোর নাম ছিল মুহাম্মদ, তথাপি তা ছিল নিরেট নূর বা আলো। হাদীস অনুযায়ী সেই আলো থেকেই মহাবিশ্বের সব কিছু সৃষ্টি হয়েছে।

এই আলো ছিল স্থান কালের (ঘটনাদৃশ্য) বাইরে (অন্তরালে)। পরে স্থানকালের (মহাশূন্য) একটা উত্তপ্ত ঘনবিন্দুর বিস্ফোরণে তা পদার্থ ও শক্তি হিসাবে আমাদের চেনা জগতে আত্মপ্রকাশ করে। এই প্রাথমিক আগ্নেয় গোলকটিতেই তৈরি হয়েছিল মহাবিশ্ব সৃষ্টির প্রয়োজনীয় কাঁচামাল।

গ্রহ-নক্ষত্রসমূহ এখান থেকেই সৃষ্টি হয়েছিল। হিসাব করা হয়েছে, মহাবিশ্ব তখন পিনের মাথার একটি বিন্দুর সমান (মতান্তরে পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব সমান) জায়গায় ১০৯: গ্রাম-বিশিষ্ট বস্তুপিণ্ড মাত্র ছিল। আজ থেকে ১৫০০ কোটি বছর আগে তা বিস্ফোরিত হয়ে আজকের বিশ্বকে গঠন করে।

এই বিশ্ব জগত আবার ৪২০০ কোটি বছরের একটি সুদীর্ঘ চক্র সমাপ্ত করার পর পদার্থ ও শক্তি স্থানকালের অন্তরালেই ফিরে যায়। বর্তমানে বিজ্ঞান বলছে, নক্ষত্রসমূহ কৃষ্ণ-বিবরে রূপান্তরিত হওয়ার পর তার সব পদার্থ ক্রমাগত একটি গাণিতিক বিন্দুতে (singularity) পতিত হয়।

সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ

কিন্তু শক্তি ও পদার্থের ধ্বংস নেই

তা হলে এই পদার্থ কোথায় যায়? বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব অনুযায়ী এই পদার্থ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে স্থানকালের বাইরে চলে যায়।

বিশ্বসৃষ্টির সময় মহাবিস্ফোরণের সময় যেখান থেকে এই শক্তি এসেছিল আবার সেখানেই তা ফিরে যায়। বর্তমানের জ্ঞান ও শক্তি দিয়ে আমরা স্থানকালের অন্তরাল বুঝতে পারছি না। এটি আমাদের দর্শন অনুজ্ঞা বা জ্ঞানের সীমার বাইরে। অথচ রসূলুল্লাহ (সা.) মি’রাজে গিয়ে স্থানকালের বাইরে (সিদরাতুল মুন্তাহা ) আল্লাহ্র দেখা পান।

কুরআনের বহু আয়াতে মহাবিশ্বের সৃষ্টি সম্পর্কে যেসব ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে তা অদ্ভুতভাবে বর্তমানের বিজ্ঞানের ধ্যান-ধারণার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। গত বিশ বছরে শ’খানেক বই প্রকাশিত হয়েছে যাতে বহু আইডিয়া প্রকাশ করা হয়েছে। গণিতে দশ মাত্রার বিশ্বের কথা আঁকা হয়েছে। জানা গেছে, এর বাইরেও বহু মাত্রার বিশ্ব থাকতে পারে।

মি’রাজে আল্লাহ তাঁর সত্তর পর্দা খুলে দিয়ে তাঁর বান্দা মুহাম্মদকে (সা.) দেখা দিয়েছিলেন

এটা খুব সম্ভবত সত্তর dimension বা মাত্রার কথা বলা হচ্ছে। আমরা ত্রি- মাত্রিক বিশ্বে বাস করি এবং সময়ের সঙ্গে ঘটনার পরম্পরায় কাল গণনা করি সম্মুখের দিকে।

আল্লাহ পাক ইচ্ছা করলে কোনরূপ যানবাহন ছাড়াই মহানবীকে তুলে নিতে পারতেন তাহলে মানুষের তর্ক, বোঝা বা চিন্তার জন্য কোন খোরাকই থাকত না।

মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই ব্যাহত হত। মি’রাজ লীলাময় স্রষ্টার একটি সামান্য লীলামাত্র। এই লীলা নিয়ে চিন্তা করা, গবেষণা করার জন্যই মানব জন্ম। মানুষের দেহের মূল হয় তাঁর আত্মা। আত্মা চলে গেলে মানুষের চেতনা লোপ পেয়ে যায়। নিদ্রায় গেলে মানুষের বাহ্যজ্ঞান লোপ পায়।

মহানবী (সা.) যখন মহান সৃষ্টিকর্তার সাথে মহামিলনের জন্যে মি’রাজে গেলেন তখন খুব সম্ভবত সমগ্র বিশ্ব জাহানের সমস্ত কিছু চেতনা হারিয়ে স্থির হয়ে পড়েছিল; যেহেতু সৃষ্টির মূল ব্যক্তিত্ব বা প্রতিনিধি সৃষ্টি হয়ে দেখা করতে গিয়েছিলেন স্রষ্টার সাথে। তিনি ছিলেন সমগ্র মহাবিশ্ব জগতের মূল নির্যাস (নূর)।

সুতরাং তাঁর (আত্মার) অনুপস্থিতিতে দেহস্বরূপ বিশ্বজগত ঘুমিয়ে পড়েছিল চেতনাহীন রূপে। হাদীস মতে হযরত মুহাম্মদ (সা.) সুদীর্ঘ ২৭ বছর কাল মি’রাজ ভ্রমণ করেন এবং এই সুদীর্ঘকাল সমগ্র সৃষ্টি জগত নিদ্রামগ্ন ছিল।

আবার যখন তিনি মাটির পৃথিবীতে ফিরে আসেন, তখন সব কিছুই জাগ্রত ও সচল হয়ে ওঠে। তাই তিনি তাঁর অযুর পানি আগের জায়গাতেই গড়িয়ে যেতে দেখলেন। কোন কোন সময় আমাদের চেতনায়ও মনে হয় অনেক সময় চলে গেছে, অথচ ঘড়িতে দেখা যায় সামান্য ক্ষণ মাত্র অবিবাহিত হয়েছে।

সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ

আধুনিক সৃষ্টিতত্ত্ব ও বিশ্ববীক্ষার আলোকে মি’রাজ

বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেন, ‘সেই অপার্থিক জগতে সময় বয় না, মহাকর্ষ নীচের দিকে টেনে নামায় না, পদার্থ বলতে সেখানে কিছুই নেই, আলোক সেখানে অচল,

পরিবর্তন সেখানে অসম্ভব। কাজেই নতুন গণিত আমাদের মনের প্রচলিত ধারণার কাছে নিয়ে যাচ্ছে।” রাশিয়ার হাইড্রোজেন বোমার জনক অসাধারণ প্রতিভাবান বিজ্ঞানী, আন্দ্রেই সাখারভ প্রমাণ করেছেন এক গবেষণাপত্রে এই, “সময় সামনে পেছনে সবখানেই যেতে পারে, এমন কি স্থিরও থাকতে পারে (t=0)।

(বেহেস্তের সময় স্থির) আর এই বিশ্বের রয়েছে আরেকটি প্রতিবিম্ব বিশ্ব বা সমান্তরাল বিশ্ব।” রুশ বিজ্ঞানী মারকভের মতে বিশ্বজগত হচ্ছে মৌচাকের মত যার ভেতরে প্রতি খোপে রয়েছে একটি করে বিশ্বজগত।

কোন জগত ইলেকট্রনের সমান আকার, কোনটি আবার বিশাল। অথচ ইলেকট্রণের অভ্যন্তরে বিশ্বজগতের রাজত্ব চলছে, সময় চলছে অবিরাম। এই বিশ্বগুলো একটি অপরটির মাঝ দিয়ে চলে যায়, তাতে কোন সংঘর্ষই ঘটে না।

এক একটির ডাইমেনশন ভিন্ন বলে অন্য ডাইমেনশনের বিশ্বের প্রাণীজগতের সঙ্গে দেখা হয় না, সংঘর্ষ বাধে না

বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা প্রচণ্ড। যাঁরা গবেষণাগারে কাজ করেন তাঁরা এটা হাড়ে হাড়ে টের পান। বিজ্ঞানের পক্ষে অতি-বিজ্ঞানকে জানা দুরূহ এবং সেখানে বিজ্ঞানের সমস্ত জ্ঞান অসীম অনন্তের বক্ষে দিশেহারা হয়ে যায়।

মহাবিশ্বের নব্বই শতাংশ জিনিষই দেখা যায় না, বাকী দশভাগে দৃশ্যমান গ্রহ-নক্ষত্র গ্যালাক্সিসমূহ জ্বলছে। মহাজগতে মোট যত প্রকার রশ্মি রয়েছে তারি ১% ভাগেরও কম আলোকরশ্মি আমরা দেখতে পাই, বাকী ৯৯% ভাগের বেশি আলোক সর্বদা আমাদের দৃষ্টির বাইরে থাকে।

যেমন, অতিবেগুনী রশ্মি, এক্সরে, অবলোহিত রশ্মি, লেসার রশ্মি ইত্যাদি। ‘আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান শুধু আল্লাহ্ই’ বা অদৃশ্যের জ্ঞান শুধু তাঁরই । তাঁর জ্ঞানের ওপর অন্য কারো কোন প্রভাব, নিয়ন্ত্রণ বা অধিকার নেই’ এমনি অনেক আয়াত কুরআনে রয়েছে।

বিশ্বের সব কিছুই আল্লাহর উপাসনায় রত

অথচ এর বৈজ্ঞানিক তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, প্রতিটি অণু তাঁর নিজের জায়গায় থেকে আন্দোলিত হচ্ছে, নাচছে, কাঁপছে, তরঙ্গায়িত হচ্ছে, যেন যিক্র করছে। কোন কিছুই থেমে নেই।

এমন কি ইলেকট্রনকে ভেঙ্গে ফেললেও তার ভেতরে পাওয়া যাবে স্পিন বা তীর-শলাকা যার একটি ঊর্ধ্বমুখী, দ্বিতীয়টি অধঃমুখী। এই স্পিনগুলোও কাঁপছে, এদের কম্পনের ফলেই ইলেকট্রন ঘুরছে। বিজ্ঞান বলছে, সমগ্র বিশ্ব এক সুতোয় বাঁধা।

বিশ্বের সব কিছুই আল্লাহর উপাসনায় রত
বিশ্বের সব কিছুই আল্লাহর উপাসনায় রত

বিজ্ঞানের ভাষা একে বলে মহাজাগতিক তার (Cosmic string)

এই তার অতিপরিবাহীরূপে কাজ করে। অদৃশ্য এই তারের বদৌলতেই আমরা মনের মধ্যে বিশ্বের শেষ প্রান্তের ছবির কথা কল্পনা করতে পারি।

একটা সংযোগ তার হচ্ছে এই মহাজাগতিক সুতো। মহানবী সম্ভবত এই কসমিক স্ট্রিং বেয়েই last frontier of the space (সিদরাতুল মুন্তাহাতে) পৌঁছে গিয়েছিলেন। পশ্চিমে দুই পাহাড়ের মধ্যে তারবাহী যানে করে মানুষ যাতায়াত করে থাকে।

সমগ্র বিশ্বজগতের সব কিছুর রহস্য সম্পর্কে জানা মানুষের মস্তিষ্কের সীমাবদ্ধতার জন্যই কোনদিন সম্ভব হবে না। যেমন, সাধারণ একটি লবণের কণায় ১০১৬ টি পরমাণু রয়েছে যাদের প্রতিটি আবার ১০টি তথ্য তরঙ্গ দ্বারা নির্ধারিত হয়।

অথচ সবচাইতে আদর্শ একটি মস্তিষ্কের তথ্য ধারণ ক্ষমতা হচ্ছে ১০১৪ । আর এই সংখ্যাটি হচ্ছে লবণের কণার মধ্যস্থিত পরমাণুর সংখ্যার হাজার ভাগের এক ভাগ মাত্র! এখন চিন্তা করে দেখুন, সময়ের বিচিত্র কাহিনী

স্রষ্টাকে সম্পূর্ণভাবে জানবার জন্য দরকার পড়বে তার সৃষ্টিকে সম্পূর্ণভাবে বোঝা । বিশ্বজগতের মাত্র ০.১ অংশ বিজ্ঞানীরা টেলিস্কোপের আওতায় ধরতে পেরেছেন, এতেই পাওয়া গেছে ১০০ কোটি গ্যালাক্সি।

বিজ্ঞানের ভাষা একে বলে মহাজাগতিক তার (Cosmic string)
বিজ্ঞানের ভাষা একে বলে মহাজাগতিক তার (Cosmic string)

প্রতিটি গ্যালাক্সিতে গড়ে ১০,০০০ থেকে ৪০,০০০ কোটি তারকা থাকে। এখন এই বিশ্ব জগত নাকি আরও অসংখ্য রয়েছে, এমন কথাই বিজ্ঞানীরা বলছেন ।

এখন বুঝুন এই মহাবিশ্বের (অসংখ্য বিশ্বজগতের সমাহার) স্রষ্টাকে বুঝতে কত বিশাল মস্তিষ্কের প্রয়োজন পড়বে? আমাদের দৃষ্টি ১৫০০ কোটি আলোকবর্ষ দূর পর্যন্ত যেতে পেরেছে (অঙ্ক কষে ও কোয়াসার দেখে)।

তারপরের সীমানা (বিশ্বজগতের মহাবিস্ফোরণের আগের মুহূর্ত থেকে পেছনের দিকে) আর আমাদের অঙ্কে, চিন্তায় ধরে না । এই প্রাপ্ত সীমানার নামই ‘সিদরাতুল মুন্তাহা’ যা পেরিয়ে গিয়ে আরো বহু দূরে আল্লাহর সন্দর্শন পেয়েছিলেন রসূলুল্লাহ (সা.)। “দৃষ্টি তাঁকে দর্শন করে না—তিনি দৃষ্টিসমূহকে দর্শন করেন” ।

সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ

বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কম্পিউটার বিজ্ঞানী ফ্রেডকিনের মতে মহাবিশ্ব তথ্যের নেটওয়ার্ক মাত্র

সৃষ্টিতে আদি ও সর্বমূল বস্তুকণা কোয়ার্কের চাইতেও এই “ইনফরমেশন’ হল একটি মৌলিক অস্তিত্ব।

আর কোয়ার্ক বা ডি এন এ গুলো মূলত অতি ক্ষুদ্র যুগ্ম ও সমন্বিত তথ্যকণার ভাণ্ডার ছাড়া আর কিছু নয় । একটি ইঁদুর, মানুষ, সবকিছুই মূলত একটি বিশাল বিস্তৃত তথ্যকণাদের পদ্ধতিগত সমষ্টিমাত্র।

আর এই ধারণাকৃত বুদ্ধি বিস্তার করছেন স্রষ্টা স্বয়ং যাতে তাঁর কোন তথ্য হারিয়ে না যায়, কোন দুর্ঘটনা না ঘটে । এই মহাবিশ্ব হচ্ছে একটি বিশাল জীবন্ত কম্পিউটার যার প্রতিটি রন্ধ্রে কণায় কণায় তথ্য পুরে দেয়া আছে এবং এই তথ্যগুলো সময় ও সুযোগ মত কম্পিউটারের মতই চাইবামাত্র তথ্য সরবরাহ করবে (যেমন হাশরের মাঠে)।

‘হারায় না কিছুই যত কথা যত গান সবি আছে সবি থাকে কিছুই যায় না ভোলা’ । সময়ের অদৃশ্য সুড়ংগে ফেলে যাওয়া আমাদের জীবনে সংঘটিত ঘটনাগুলো ফ্রেডকিনের “বিটে বিটে” জমা হচ্ছে। হারিয়ে যাবে না ওরা।

হারিয়ে যায় শুধু আমাদের বস্তুগুলো, দেহগুলো। বেঁচে থাকে প্রাণ, মৃত্যুর তোরণ পাড়িয়ে দিয়ে প্রবেশ করে আরেক অচেনা জগতে, তারপর একদিন হবে পুনরুত্থান। [প্রাণ এনার্জি (হিন্দু মতে), বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড শুধু এনার্জিতে ভরা]

আমরা আগেই বলেছি যে, আলোর গতিবেগ হল প্রতি সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার যা হল সমগ্র ভূপৃষ্ঠকে ৭ বার ঘুরে আসার সমান দূরত্ব।

আইনস্টাইনের আপেক্ষকিতাবাদে আলোর এই গতিই সর্বোচ্চ বেগ এবং এটা ধ্রুবক

আলোর গতিবেগের ৯৯.৯৯৯৯৫% গতিবেগসম্পন্ন কোনও মাধ্যমে বা মহাকাশযানে কোনও পর্যবেক্ষকের ঘড়িতে এক বছর অতিক্রান্ত হলে পৃথিবীতে ততটা সময়ে পার্থিব এক হাজার বছর কেটে যাবে।

এই ঘটনাকেই বলা হয় কাল প্রসরণ বা Time Dilation অর্থাৎ আলোর সমান গতিবেগসম্পন্ন কোন পর্যবেক্ষণের মুহূর্তমাত্র সময় পৃথিবীতে অনন্তকাল হয়ে উঠবে।

আলোর কাছাকাছি গতিবেগ তাই সম্ভব, কিন্তু আলোর সমান গতিবেগ কখনও কারো হতে পারবে না। সময় সম্পর্কে এই ধারণার বয়স মাত্র ৯০ বছর ।

রসূলুল্লাহ্ (সা.) যে আলোর গতিতে বুরাকে চড়ে মি’রাজে যাননি তার প্রমাণ হচ্ছে তাহলে স্থানকালের অন্তরালে যেতে ১৫০০ কোটি বছর লেগে যেত। তিনি ত ‘নূর’ ছিলেন ঠিকই, তবে এ নূর আলোকের চাইতেও অধিক শক্তিসম্পন্ন জ্যোতি বিশেষ।

ইদানীং আলোর চেয়ে বেশি গতিবেগসম্পন্ন কণার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে, যার নাম দেওয়া হয়েছে ট্যাকিয়ন ( Tachyon) । এই ট্যাকিয়ন’ হল আইনস্টাইনীয় ভরের (mass-m) প্রতিরূপ।

১৯৬৭ সালে নিইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বীয় পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক জেরাল্ড ফাইনবার্গ তার ট্যাকিয়ন সূত্র প্রকাশ করেছেন। আইনস্টাইন বলেছিলেন, ভর (বস্তু) আলোর গতিবেগের সমান গতিবেগে অপরিমিত বিশালতা লাভ করবে।

ফাইনবার্গ অঙ্ক কষে দেখালেন আইনস্টানীয় ভরের প্রতিরূপ আছে

সেগুলো হলো ট্যাকিয়ন। তাঁর মতে ট্যাকিয়ন আলোর চেয়ে লক্ষ কোটি গুণ দ্রুততর, কিন্তু আলোর গতি বা তার চেয়ে কম গতিতে তাকে নামিয়ে আনলে তার অস্তিত্বের বিলুপ্তি ঘটে। তা হলে ট্যাকিয়নের গতিতে সময়ের ধারণা কি রকম হবে?

তখন তথাকথিত অতীতই ভবিষ্যত হবে । আইনস্টাইন যেমন বলেছিলেন, আজ যাত্রা শুরু করে গতকাল— এ পৌঁছানো যাবে।

অঙ্ক কষে এ কণার অস্তিত্ব প্রমাণিত হলেও বাস্তবে এর অস্তিত্ব এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। তবে আপেক্ষিকতাবাদের ধারণানুযায়ী কোন কণা আলোর গতির কাছাকাছি এসে পৌঁছালে তার ভর হবে অতি বিশাল (অসীম), তখন সে কণা আলোর গতির নাগালও ধরতে পারে না, পারে না সেই সীমানা টপকাতে—এই ধারণাটি মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।

ইউরোপীয় কমিশনের সের্ন-এ-(CERN) ল্যাবরেটরীতে যে বিশেষ ধরনের কণাত্বরণ বা synchrotron আছে তাতে মৌলিক কণাগুলোকে আলোর গতির শতকরা ৯৯.৫ ভাগের সমান গতিবেগে ইতোমধ্যেই ত্বরান্বিত করার পর দেখা গেছে তাদের ভর অসীম হয়নি ! কে জানে হয়ত ৯৯.৯৯ ভাগের সময় অসীম হয়ে যাবে !

ডীমার কিন্তু মৌলিক কণাগুলোকে মোটামুটি তিনভাগে ভাগ করেছেন। একরকম কণা হলো যারা আলোর চেয়ে কম গতিতে ছোটে । যেমন : নিউক্লিয়ন আর ইলেকট্রন। এরা প্রথম শ্রেণীভুক্ত।

দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে ফোটন ও নিউট্রনের মত কণা, যারা আলোর সমান গতিবেগে ছোটে। আর তৃতীয় শ্রেণীতে আছে ট্যাকিয়ন, যে নাকি আলোর চেয়ে দ্রুততর গতিতে ছুটতে পারে, যার বাস্তব অস্তিত্ব আজও অনাবিষ্কৃত এবং আলোর গতির সমান বা তার চেয়ে কম গতিতে যার অস্তিত্বের বিলুপ্তি ঘটে।

বিজ্ঞানীরা এখন বলছেন, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর কণার ক্ষেত্রে আপেক্ষিকতাবাদ প্রযোজ্য হলেও তৃতীয় শ্রেণীর কণা অর্থাৎ ট্যাকিয়নের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হবে না।

প্রথম শ্রেণীর কণাগুলোকে যেমন কখনও আলোর গতিতে ছোটানো যায় না, তেমনি ট্যাকিয়নের গতিকেও কখনও আলোর গতিতে নামিয়ে আনা যায় না।

সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ

এ যেন দিন রাত্রিকে ধরতে পারে না, রাত্রি দিনকে

ধরনের কুরআনের বাণী । আবার ফোটন ও নিউট্রনের গতি থামিয়ে দিলে তাদের বিলুপ্তি ঘটে। সুতরাং ট্যাকিয়ন প্রথম দুই শ্রেণীর কণার একেবারে বিপরীতধর্মী।

সেইজন্য ট্যাকিয়ন অথবা অপরা পদার্থ (anti-matter) যা আইনস্টাইনীয় ভরের প্রতিরূপ। ট্যাকিয়ন দুনিয়ার মানুষের ‘দূর ভবিষ্যত হবে আমাদের দূর অতীত’। সমান্তরাল বিশ্বের ধারণার সঙ্গে ট্যাকিয়নের যোগসূত্র আছে ৷

সুমেরীয় সভ্যতার রাজাদের তালিকায় দেখা যায় তখনকার রাজারা ৪৩৩,৬৩,২২,৮২১ হাজার বছর রাজত্ব করেছিলেন। তিব্বতীয় লামা ধর্মের প্রাচীন পুঁথি

‘কাঞ্জুর’ ও ‘তার’-এ ষড়ম্বর সংগ্রহ’ বইয়ের ‘দেববাণী’ পরিচ্ছদে মহাবিশ্বে নানা স্বর্গের কথা বলা হয়েছে যেখানে ১ম স্বর্গের ১টি দিবারাত্রের সমান হচ্ছে পৃথিবীর ৫০ বৎসরের সমান।

এখানে দেবতারা ৫০০ বছর তথা পৃথিবীর ৯০ লক্ষ বছর বাঁচেন। এভাবে ক্রমান্বয়ে ২য়, ৩য়, ৪র্থ, ৫ম পেরিয়ে বিশেষ স্বর্গ ৬ষ্ঠ নম্বরে দেখা যায় সেখানকার এক একটি দিন পৃথিবীর ১৬০০ বছরের সমান।

কুরআনে রয়েছে একদিন সমান পঞ্চাশ হাজার বছরের কথা

“এমন একদিন ফেরেশ্তা ও রূহ আল্লাহ্র দিকে ঊর্ধ্বগামী হবে যা পার্থিব পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান।” (মা’আরিজ : ৭০ : ৪)। ষষ্ঠ স্বর্গের দেবতাদের আয়ুষ্কাল ১৬০০ বছর হিসাবে ৯২১ কোটি ৬০ লক্ষ বছরের সমান।

দেবতারা যেসব স্বর্গে আছেন বলে বলা হচ্ছে সেগুলো পৃথিবীর আপেক্ষিকে দ্রুততরভাবে গতিশীল কোন গ্রহ যা আমাদের সৌরমণ্ডলের যথেষ্ট বাইরে অবস্থিত। বিভিন্ন স্বর্গ বিভিন্ন বেগে গতিশীল ভিন্ন ভিন্ন গ্রহের কথাই বলে। আর সবগুলোই পৃথিবীর চেয়ে বেশি গতিবেগ সম্পন্ন বলেই প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঘটেছে কাল-প্রসরণ।

অঙ্ক কষে প্রমাণ করা গেছে, দেবতারা যে লোকে অবস্থান করেন তা আলোর বেগের ৯৯.৯৯৯৬১% গতিবেগসম্পন্ন। এই দেবতাদের এক বছর হয় ৩৬০ পার্থিব বছরে। এঁদের পরমায়ু ১০০ দিব্য-বছর যা আমাদের ৩৬০০০ পার্থিব বছরের সমান

ভারতীয় দর্শন বলছে, পৃথিবী কর্মভূমি, সাধন ভূমি। পৃথিবীর কর্মফল দিয়ে সাতটি ঊর্ধ্বলোক এবং সাতটি অধঃলোক গড়া। সপ্তম ঊর্ধ্বলোক হলো ‘সত্যলোক। সেখানে উপলব্ধ সত্য মহাসত্যের সঙ্গে মিশে যায়—ব্রহ্মে লীন হয়ে যায় মহাপ্রলয়ের সময় ।

এই লোকগুলো প্রত্যেকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত

ভাগগুলো যেন এক একটি স্তর! বিভিন্ন গতিবেগসম্পন্ন এইসব লোককে আবার ভিন্ন ভিন্ন পরিকাঠামো বলে ধরা যায় ।

গতিশীল এইসব লোকে পৌঁছতে হলেও বিভিন্ন ধরনের গতির প্রয়োজন। ভারতীয় দর্শনে তাই বিভিন্ন লোকের উপযোগী বিভিন্ন গতির কথা বলা হয়েছে। আলোর গতি বা বিদ্যুৎ গতির চাইতেও অনেকগুণ বেশি সেসব গতিবেগ।

বিভিন্ন গতির নাম হলো বিদ্যুৎগতি, ধূম্রযানগতি, দেবযানগতি, আকাশগতি, মহাকাশগতি, ইচ্ছাগতি, ঐশীগতি ও স্থিরা গতি। বিদ্যুৎ আলোর গতির দশগুণ হলো ধুম্রযানগতি।

সর্বশেষ স্থিরগতি হল আলোর বেগের ১০৭ বা এক কোটি গুণ-ট্যাকিয়নের গতি । স্থিরা গতিকে বলা হয়েছে পরব্রহ্মের গতি, যে গতিতে নাকি গতি নেই। পরব্রহ্ম (সৃষ্টিকর্তা) তাই সর্বত্র সব সময়েই উপস্থিত। তাঁর কাছে সময় নেই। ব্রহ্ম নিজে দেশকাল নিমিত্তর মধ্য দিয়েই গত হয়েছেন। ব্রহ্মে দেশকাল নিমিত্ত নেই।

দেশ বলতে আমরা মহাকাশ আর কাল বলতে সময়, নিমিত্ত বলতে কার্য-কারণ বুঝি । আইনস্টাইন এই কার্যকারণ সম্পর্কের বাইরে পা বাড়ান নি একবারও । সুতরাং ব্রহ্ম মহাকাশ সময়-সন্ততি ও কার্যকরণ সম্পর্কের ভেতর দিয়েই বিশ্বজগত হয়েছেন।

সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ

আর পরব্রহ্ম বলতে উপনিষদ যা বলছে তা হল বিশ্বের সমস্ত জ্ঞানের সমষ্টি

যাকে আমরা চৈতন্য বা তথ্য বলি, সেই চৈতন্যবিজড়িত ‘প্রকৃতি’, যে প্রকৃতিকে আমরা বিশ্বের সমস্ত বস্তু ও শক্তির সমষ্টি বলতে পারি অর্থাৎ চৈতন্যবিজড়িত মহাজাগতিক ডিম্বই হচ্ছেন সৃষ্টিকর্তা বা পরব্রহ্ম। আর সেই ঈশ্বরই দেশকালের চতুর্থমাত্রা ও কার্যকারণ সম্পর্কের

মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান জগত হয়েছেন। এই ঈশ্বরই পরব্রহ্ম । সময়ের মাত্রা জগতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে, পরব্রহ্মের ক্ষেত্রে নয়। কারণ কসমিক এগের কোন মাত্রা থাকবে এটা বিজ্ঞানও মনে করে না । সুতরাং ব্রহ্মা বা সৃষ্টিকর্তা সময় নিরপেক্ষ । সেখানে মহাকাশ সময়-সন্ততি ও কার্যকারণ সম্পর্ক সবই অনুপস্থিত।

পরব্রহ্মের স্থিরা গতিতে বা তার আগের ঐশী গতির মধ্যে কোন একটিতে মি’রাজ সম্পন্ন হয়েছিল বলে আভাষ পাওয়া যায়।

আল্লাহ্পাক মক্কাতেও আছেন, জেরুজালেমেও আছেন, মহানবীর সঙ্গেও আছেন, আবার জিবরাইলের সঙ্গেও আছেন, মহাবিশ্বের সপ্তাকাশ ও সপ্তজমিনের মধ্যে আছেন—সর্বত্রই তিনি আছেন একই সময়ে। অথচ সময়ের মাত্রা বিভিন্ন। আল্লাহ পাক মাত্রাহীন বা dimensionless এবং মাত্রার বাইরে তাঁর অবস্থান।

তাই তিনি এক মুহূর্তের মধ্যে মহানবীকে তাঁর নিজের কাছে নিয়ে আসেন ট্যাকিয়ন যানে করে। কয়েক পলকে সমগ্র স্বর্গ মর্ত্যকে তাঁর চোখের সামনে তুলে ধরা হোল, তাঁকে সমস্ত কিছু ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেয়া হলো। আল্লাহ তাঁর রসূলকে স্থানপাত্র ও কালের ঊর্ধ্বে নিয়ে গিয়েছিলেন।

তাই তিনি অবলীলাক্রমে দেখতে পেয়েছিলেন তাঁর অতীত ও ভাবী-মানবধারাকে

তিনি দেখেছিলেন সমস্ত যুগের নবী ও সব মানবাত্মাকে । তিনি দেখেছিলেন ফেরেশতাদের কার্যকাল । মহানবীর আত্মা নবৃওয়াতের বহু পূর্বেই বিশ্ব রহস্য জানার জন্য আকুল প্রার্থনায় ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল।

নবৃওয়াতের দশম বছর পর্যন্ত অনুধাবন ও অনুশীলন চলছে । সুতরাং এ বিশ্ব রহস্য প্রহেলিকার মাঝে মুহাম্মদ (সা.) যে কেমন মানুষ ছিলেন, এ নিগূঢ় রহস্য উদ্ধারে আরো লক্ষ লক্ষ বছর কেটে যাবে।

হযরতের জীবনের যে কোন একটি দিক একটু ধীর ও স্থিরভাবে লক্ষ্য করলে যে কোন চিন্তাশীল মানুষই অবাক বিস্ময়ে অভিভূত না হয়ে পারেন না। তাঁকে নিছক একজন ধর্মপ্রচারক ও সমাজ-সংস্কারক মহামানবরূপে দেখলে সূর্যকে একটি সর্ষের দানার রূপেই দেখা হবে । এমনটি পড়েছিলাম কোন এক মনীষীর লেখায়।

আল্লাহ্ তাঁর সকল নবীকেই বিশ্বরহস্য জানিয়ে দেন। ঐ জ্ঞান ব্যতীত তাঁরা বিশ্বের গতি নির্দেশ করবেন কি করে? “আমি এভাবে ইবরাহীমকে আসমান ও যমিনের পরিচালনা ব্যবস্থা দেখাই যাতে সে নিশ্চিত বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়” (আনআম : ৭৫)

যে ব্যক্তি কখনও হাতী দেখেনি, যে যত বড়ই জ্ঞানী হোক তার পক্ষে অন্যকে হাতী সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞান দান করা অসম্ভব । সুতরাং প্রত্যেক নবীরই প্রয়োজন প্রত্যক্ষ জ্ঞানের। এই প্রত্যক্ষ জ্ঞান তাঁরা পেয়েছেন মি’রাজের মাধ্যমে । কোন নবীই বৈজ্ঞানিক বা দার্শনিক নন।

সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ

বৈজ্ঞানিকগণ বিশ্বরহস্য সম্পর্কে যতটা বলতে পারেন

নবীগণ তা অপেক্ষা বহুগুণে বেশি বলতে পারেন। অতীত ও ভবিষ্যত সম্পর্কে তাঁদের ধ্যান ও ধারণা সাধারণ মানুষের চিন্তার বাইরে।

আধ্যাত্মিক জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কারো পক্ষেই জগত—সত্য সম্পর্কে শেষ কথা বলা সম্ভব নয়। তারাই বলতে সক্ষম হয়েছেন যাঁরা বাস্তব দৃষ্টিতে সবকিছু উপলব্ধি করেছে।

মুকাবেলা করেছিলেন? চরম ও পরম সত্য যে কি, তা তিনি জানতেন বলেই তিনি অসত্যের বিরুদ্ধে অটলভাবে দাঁড়িয়েছিলেন। আমরা জানি যে, এখন থেকে কোন এক নির্দিষ্ট পরিমাণ কাল পরে (যার সম্পর্কে আল্লাহ পাক ছাড়া আর কেউ জানে না) বিশ্বজগৎ ধ্বংস হয়ে যাবে, (বিজ্ঞান ও কুরআন এভাবে একই কথা বলে।)

তারপর আল্লাহ্পাক আবার সৃষ্টি করবেন, হাশরের মাঠে শেষ বিচার করবেন সবার পাপ-পুণ্যের, তারপর রায় অনুসারে সবাই বেহে ও দোযখে চলে যাবে। অথচ মহানবী মি’রাজের রাতেই অগ্রিম তা দেখে ফেলেছেন ।

প্রশ্ন দাঁড়াবে এটা কিভাবে সম্ভব? কোন কিছুই আমরা প্রমাণ করতে পারব না । এই পুরো প্রবন্ধ জুড়ে এমনি বক্তব্যই পেশ করা হয়েছে যে, পারিপার্শ্বিক প্রমাণ বা পরোক্ষ প্রমাণ (গাণিতিক) ছাড়া বর্তমান মুহূর্তে বিজ্ঞানের হাতে কিছু নেই।

খুব সম্ভবত বিশ্বসৃষ্টি শুধু ১৫০০ কোটি বছর আগে একবারই হয়নি

তারও আগে এমনি লক্ষ কোটিবার মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে, কোনো বার বিগব্যাং প্রক্রিয়া দ্বারা, কোনবার ফেঁপে উঠেছে বিশ্বজগত (Inflated universe), কোনো বার অসংখ্য বুদ্বুদ- মহাবিশ্ব ভেসে উঠেছে, এমনি ধরনের বহু আইডিয়া বা প্রকল্প বিজ্ঞানীরা মডেল হিসাবে দিয়েছেন।

মনস্তত্ববিদ্যায় বলে যে, যত উদ্ভট চিন্তাই মাথায় আসুক না কেন, সব কিছু কোন অতীত কালে সংঘটিত বাস্তব অবস্থার প্রক্ষেপণ (Projection) ও প্রতিফলন প্রক্রিয়ামাত্র।

তাই মনে হয়, যতবার যতগুলো বিশ্বজগত সৃষ্টি হয়েছে আর ধ্বংস হয়েছে সবি রয়ে গেছে সৃষ্টিকর্তার মানসনেত্রে; তারা আছে “কম্পিউটারের মেমোরী”তে সংরক্ষিত হয়ে, বিশ্বগুলি পরপর সাজানো রয়েছে সুতার কুণ্ডলীর মত পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে। একের ভেতর এক বিশ্ব এক এক মাত্রার।

তাই সাত আকাশ সত্তর পর্দা এই কথাগুলো ঠিক সাত, সত্তর না বুঝিয়ে অসংখ্য সংখ্যা বোঝাতে পারে। এই দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা ও সময় নিয়ে গঠিত চতুর্থ মাত্রার বিশ্বের বাইরে অন্য কোন ডাইমেনশনের বিশ্বে বেহেস্ত ও দোযখ রয়ে গেছে। স্রষ্টার কাছে অতীত বর্তমান ভবিষ্যত কিছুই নেই।

অনেক বৈজ্ঞানিক বলেন, স্ৰষ্টা সব কিছুই একবারেই সৃষ্টি করে ফেলেছেন, তিনি বিশ্ব জগতকে প্রসারিত করছেন, বেলুনে ফুঁ দেবার মত করে । তাই তার কাছে সবই জ্ঞাত, সবকিছুই এক স্কেলে মাপা।

আঠার হাজার আলম (সৌরজগত) সম্পর্কে তাঁকে মহানবীকে জ্ঞান দেয়ার পর তাঁকে মানবমণ্ডলী সম্পর্কে যথাযথভাবে অবহিত করা হল। প্রত্যেক মানুষেরই একটি জীবনী খাতা আছে।

সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ

সেখানে দিবা-রাত্রি রেকর্ড হচ্ছে (সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ)

যে যা করছে, ভাল-মন্দ সবাই তাতে লেখা হচ্ছে । অতঃপর আল্লাহ্তা’আলা তাঁর রসূলকে জগতের ভূত ভবিষ্যত ও উত্থান- পতন সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান দান করেন।

মানুষ যেন মনে না করে যে রাজত্ব শুধু তাদেরই কৃতিফল মাত্র। এরপর আল্লাহতা’আলা তাঁর প্রিয় রসূলকে জাগতিক কয়েকটি সূক্ষ্ম জ্ঞান দান করেন।

এইগুলো মানুষ যদি তাঁর দৈনন্দিন চলার পথে এতটুকুও স্মরণ করে চলে, তাহলে সাধারণ মানুষ মহামানব বা অতিমানব না হতে পারে, কিন্তু নিশ্চিত সে অমানুষ হবে না।

এরপর সমগ্র বিশ্বজগতের পরিচালক (আল্লাহ) সম্পর্কে তাঁকে সম্যক জ্ঞান দান করা হয়। এই বিশ্বজগতে আল্লাহর কোন সহকারী, পুত্র, সাহায্যকারী, প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।, তিনি এক ও একক। “বল, ওদের কথামত যদি তাঁর সাথে আরো উপাস্য থাকত, তবে তারা

আরশ অধিপতির প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার উপায় অন্বেষণ করত।” (১৭ : ৪২-৪৩)। মহানবী জানতে পারলেন পরিচালক একজনই আছেন এবং জগতসংসার সবকিছু তাঁরই নিয়ন্ত্রণাধীনে ।

যখন কেউ এক ও অদ্বিতীয়ের উপাসনা হতে বিরত থাকত, তখন মহানবীর মনে খুবই কষ্ট হত । তাই তাঁকে দেখানো হলো সপ্ত আকাশ, পৃথিবী এবং ওদের অন্তর্বর্তী সমস্ত কিছুই তাঁরই পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে এবং এমন কিছু নেই যা তাঁর প্রশংসা, পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে না; কিন্তু ওদের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা তোমরা বুঝতে পার না। (১৭ : 88 )

কোয়ান্টাম তত্ত্বের নিরিখে সময়, স্রষ্টা ও বিশ্বজগতের প্রকৃতি

বিরাট বিরাট গ্রহ-নক্ষত্র, নীহারিকা, গ্যালাক্সি, কোয়াজারগুলো গঠিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আদিকণা বা Elementary Particle দ্বারা। ৯২ টির মত মৌলিক পদার্থ দিয়ে বিশ্ব গঠিত, আরো ১২টি স্বল্পস্থায়ী মৌলেরও হঠাৎ দেখা মেলে পরীক্ষাগারে।

প্রতিটি মৌল বা মৌলিক পদার্থের প্রতিটি কণার পরমাণুর অভ্যন্তরে রয়েছে কেন্দ্রে প্রোটন, নিউট্রন বা পজিট্রন, কেন্দ্রের বাইরে কক্ষপথে পভ্রিমণরত ইলেকট্রন।

সেকেন্ডের দশকোটি (১০-১৫) ভাগের এক ভাগ সময়ের মধ্যে হাইড্রোজেন পরমাণুর ইলেকট্রন প্রোটনকে একবার ঘুরে আসে। ১০-১৮ থেকে ১০-২২ ভাগ সময়ের মধ্যে এক্সরশ্মি বা গামারশ্মি কোন নির্দিষ্ট বিন্দু অতিক্রম করতে পারে।

কেন্দ্রকে ভেঙ্গে ফেললে পাওয়া যায় প্রাথমিক কণিকা বা Elementary particle। এ ধরনের প্রায় ২০০টি কণিকার সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা–যাদেরকে বিশ্বসৃষ্টির মূল উপাদান (ইট) মনে করা হচ্ছে এখন। এই কণিকাগুলো (Quark) ১০-২০ সেকেন্ড সময় টিকে থাকে, তারপর অদৃশ্য হয়ে যায়।

ঐতিহ্যবাদী পদার্থ বিজ্ঞানের ধারণামতে আরো হল বিদ্যুৎ চুম্বকায়িত তরঙ্গ বা বৈদ্যুতিক চুম্বক ক্ষেত্রের ঢেউ। ১৯০০ সালে ম্যাক্স প্ল্যাক্স প্রমাণ করেন যে, আলো অদৃশ্য কিছু পিণ্ডের বা প্যাকেটের আকারে চলে। ল্যাটিন ভাষায় এই পিণ্ড বা প্যাকেটের নাম কোয়ান্টাম। সেই থেকে কোয়ান্টাম-পদ্ধতির উদ্ভব।

সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ

তবে সাধারণ্যে আজও তা তেমন প্রচারিত নয় (সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ)

এই তত্ত্বের মধ্যে এমন কিছু বক্তব্য আছে যা মানুষকে মন ও বস্তুজগতের গভীর অন্তঃপুরে তাকাবার সুযোগ করে দিয়েছে।

এখন আল্লাহ্কে বুঝতে গেলেও কোয়ান্টাম তত্ত্বের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে হবে। অনেকে কোয়ান্টাম তত্ত্ব ও প্রাচীন মরমিয়াবাদের মধ্যে একটা নিবিড় সংযোগ খুঁজে পাচ্ছেন।

বর্তমানে যার যে ধর্মই থাকনা কেন, কোয়ান্টাম তত্ত্বকে বাদ দিয়ে তার যথার্থতা কারো পক্ষেই সম্যক উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। প্রকৃতির যথার্থ ভাগ্য যেন এই তত্ত্বের মাধ্যমেই পরিষ্কার হচ্ছে।

এই তত্ত্বের জন্ম হয়েছিল অণুর কার্যকারণ পদ্ধতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে গঠনপ্রণালী বিশ্লেষণ করার প্রচেষ্টা থাকে। ফলে কোয়ান্টাম বিজ্ঞান ক্ষুদ্র বিশ্বের (Microworld)-এর সঙ্গে যুক্ত।

এই তত্ত্ব থেকেই আমরা পেয়েছি লেজার, ট্রাঞ্জিস্টার, টেলিভিশন, সুপার কন্ডাকটর ও পরমাণু শক্তি। বিশ্বজগতের স্বরূপ বুঝতে এই তত্ত্বের সংক্ষিপ্ত আলোচনা আমরা এখন করব।

অতীতে বিভিন্ন ধর্মের লোকেরা বিশ্বাস করত ধর্মগ্রন্থগুলো স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার মুখনিঃসৃত। তারপর প্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জ্ঞান বাড়ল, প্রকৃতির অলৌকিক ব্যাপারগুলো একটু একটু করে ঢুকতে লাগল লৌকিকতার ভাণ্ডারে।

ফলে জানার স্পৃহা বাড়ল আরো, জাগল নতুন নতুন প্রশ্ন। ধর্মগ্রন্থের ব্যাখার সঙ্গে সংঘাত লাগল নতুন পাওয়া জ্ঞানের। শুরু হয়ে গেল ধর্মের সঙ্গে বিজ্ঞানের সংঘর্ষ।

বিজ্ঞানমনস্কদের ধারণা হল যা কিছুরই অস্তিত্ব আছে, তাই জানা যাবে, মাপা যাবে বিজ্ঞানের সাহায্যে

একদিকে বস্তুজগৎ, অন্যদিকে মন-আত্মা-চৈতন্য : একদিকে আধিভৌতিক—আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার মধ্যে, অন্যদিকে আদিদৈবিক-সব ধরা ছোঁয়ার বাইরে—এই দুয়ের মাঝে কিভাবে হয়েছে সমন্বয়।

এ প্রশ্নের জবাব নিয়ে চিন্তাবিদরা হাজার হাজার বছর ধরে মাথা ঘামাচ্ছেন। দেকার্তে বল্লেন (১৫৯৬–১৬৫০), দুটোই সত্য, কিন্তু দুটো চলে সমান্তরালভাবে, তাই সমন্বয়ের প্রশ্ন নেই।

পরবর্তী চিন্তাবিদদের কেউ গেলেন আদিদৈবিকের দিকে, সৃষ্টি করলেন নানা ভাববাদ। অন্যরা গেলেন আদিভৌতিকের দিকে, তৈরি হল বস্তুবাদ।

বস্তুবাদী বিজ্ঞান সারা জগতের সব রহস্য ভেদ করতে চাইল নানা রকমের কৌশল শিখে প্রকৃতিকে কব্জা করতে। কিন্তু মাথার ওপরে যদি স্রষ্টা থাকেন, কিভাবে সম্রাট হবে মানুষ? এই উপলব্ধিই বিজ্ঞানের নাস্তিকতার মূলে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জ্ঞান বেড়েছে। বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এসে দেখা গেল বিজ্ঞানীরা সৃষ্টিকর্তার দিকে ঝুঁকেছেন। দর্শনে দুটো প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে আদিভৌতিক ও আদিদৈবিকের সমন্বয় এবং জগতের সৃষ্টির ব্যাখ্যা) মন ও বস্তুর সমন্বয় করতে পারেনি।

সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ

বিজ্ঞানের বস্তুবাদী তত্ত্ব মগজের নিউরণগুলির মিথষ্ক্রিয়াকেই মন বলতে চায়

কিন্তু ১৯৮১-র নোবেলজয়ী মার্কিন মস্তিষ্ক-বিশেষজ্ঞ রজার পেরি বলেন যে, মনের আলাদা অস্তিত্ব রয়েছে যা বস্তুকে প্রভাবিত করতে পারে। অন্য জীববিজ্ঞানীরাও আদিদৈবিকের আলাদা অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়েছেন।

তবে এই দ্বৈতবাদ সমন্বয়কামী । এদিকে পদার্থবিদরা দ্বৈতবাদ থেকে ভূরীয় অদ্বৈতবাদের (transcendental monism) দিকে ঝুঁকেছেন। বস্তুবাদের ওপর প্রথম আঘাতটা ছিল আইনস্টাইনের। সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ অনুযায়ী বস্তুকে তিনি স্পেসটাইমের ভাঁজ বানিয়ে দিয়েছিলেন, এই ভাঁজ-সৃষ্টির কারণ মহাকর্ষ।

বস্তুকে নাকচ করার পর পদার্থবিদরা ক্রমশ চৈতন্যে গিয়ে পৌঁছলেন । এখন বিজ্ঞানীদের ধারণা হয়েছে যে, কণাগুলোও চৈতন্যময় । ঢেউ গতিবিদ্যার জনক এরভিন শ্রডিঙ্গার এই জগতব্যাপী চৈতন্যকে বহুখণ্ডে বিভক্ত না করে এক ও অখণ্ড ধরতে চাইলেন।

পদার্থ বিজ্ঞানীরা জটিল তত্ত্ব ও জটিলতার অঙ্ক নিয়ে ঘাঁটতে ঘাঁটতে বস্তুজগত ছাড়িয়ে শেষ পর্যন্ত অখণ্ড পরমচৈতন্যে গিয়ে পৌঁছেছেন। এটি কিভাবে সম্ভব হল তার কিছু ব্যাখ্যার চেষ্টা সংক্ষেপে করা যাক।

সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ

আগে ধারণা ছিল বস্তু ও শক্তি আলাদা (সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ)

কিন্তু আইনস্টাইন দেখালেন যে, ভর ও শক্তি পরস্পর পরিবর্তনযোগ্য এবং এরা আপেক্ষিক কিন্তু ক্রিয়া হল অনপেক্ষ। মহাকর্ষ নেহাতই একটি কল্পিত জিনিস। পুরো জগতটাই স্পেস-টাইমের গতিশীল ভাঁজ, এর বাস্তবিক অস্তিত্ব নেই।

তবু আমরা এই রূপহীন জিনিসটাকে নানারূপে দেখি। এইভাবে আধুনিক পদার্থবিদ্যা বস্তু ও শক্তির অভিন্নতা প্রতিপাদন করে শেষে পুরোটাকেই অস্তিত্বহীন করে দিল।

১৯২৬ সালে জার্মানীর হাইসেনবার্গ দিলেন তাঁর অনিশ্চয়তা সূত্র। এই সূত্রানুযায়ী একটা কণার অবস্থান ও ভর বেগ দুটোই একই সঙ্গে নিখুঁতভাবে মাপা যায় না।

একটা যত নিখুঁত হয়, অন্যটা অনিশ্চিত হয়ে যায়। এই নিয়ম শুধু কণাজগতের নিয়ম নয়, সাধারণভাবে এটা সমগ্র জগতের বেলায় খাটে অর্থাৎ নিশ্চিতভাৱে কোন কিছু জানা সম্ভব নয়। প্রকৃতির আচরণে কার্যকারণ সূত্র আবশ্যিক নয়, যদৃচ্ছভাবে ঘটনা ঘটতে পারে।

তিনি দ্বৈত বিশ্বের ধারণা দিলেন—একটি হচ্ছে বহু সম্ভাবনার সমষ্টি; অন্যটা হচ্ছে একটি মাত্র বাস্তব যা ছিল, সেই সম্ভাবনায় লীন। এটিকে না মেনে হিউ এভারেট দিলেন বহু বিশ্বের ধারণা অর্থাৎ সবকটি সম্ভাবনাই বাস্তবায়িত হয় কিন্তু থাকে আলাদা আলাদা চতুর্মাত্রায়।

সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ

বিজ্ঞানীর অবস্থান একটিমাত্র চতুর্মাত্রায়

তাই তিনি যখন দেখতে যান, তখন একটা বাস্তব পান, অন্যগুলো পান না। জন বেল এবং ১৯৮২ সনে আম্পেক্ট পরীক্ষা করে নিশ্চিতভাবে দেখলেন অনিশ্চয়তা সূত্র সত্য। প্রমাণিত হল, দুটো কণা একদা কাছাকাছি থেকে মিথষ্ক্রিয়া চালিয়ে পরে দূরে চলে গেলেও পরস্পরকে প্রভাবিত করতে পারে।

জগত সৃষ্টির সময় সব কণাই কাছাকাছি ছিল । পরে বহু দূরে (কোটি কোটি আলোক বর্ষ দূরে) চলে গেছে। অতএব এখনও তারা পরস্পরকে প্রভাবিত করে।

একেই বলে ম্যাকের নীতি অর্থাৎ যে কোন একটি ঘটনা বাকি জগতকে তৎক্ষণাৎ প্রভাবিত করে। এমনি কথা কিন্তু কুরআন ১৪০০ বছর আগেই বলেছে। শুধু একটি আয়াত নয়, ডজন ডজন আয়াত রয়েছে এ সম্পর্কে যার কিছু প্রবন্ধের প্রথম দিকে উদ্ধৃত হয়েছে।

কিভাবে জগতের একটা খণ্ডাংশ (কণা) বাকি সমস্তটাকে প্রভাবিত করে? এ কারণেই ডেভিড বোহম খন্ডের বদলে অখণ্ডকে স্বীকার করেছেন। এই অখণ্ড সত্তাকে কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যায় বলে ফিল্ড-শূন্য ফিল্ড।

কিন্তু দেখা গেল, এই শূন্য থেকে ‘ভারচুয়াল’ (অলীক) কণার দল আচমকা লাফিয়ে উঠে নেচে বেড়ায়, আবার ডুবে যায় । কণা হয়ে যা কণা নয়, তাই হচ্ছে ভারচুয়াল কণা, আস্তি ও নাস্তির মাপে তা ডিগবাজি খায়।

মৌলিক বলগুলোর পরিবাহী-গ্লুওনগুলো হচ্ছে ভারচুয়াল কণা

যথেষ্ট শক্তি জোগালে এরা কণা হতে পারে। তাই এখন ভাবা হয় শূন্য—আসলে শূন্য নয়, আসলে এটা পূৰ্ণ (এনার্জি)।

বাস্তব সবকিছুরই রূপান্তর ঘটে, কিন্তু নাস্তি কিভাবে অস্তি হয়? শূন্যটা আসলে পূর্ণ । কিন্তু তাঁর চরিত্র কি? এক অংশে আন্দোলন ঘটলে কিভাবে তা সঙ্গে সঙ্গে সঞ্চারিত হয় সর্বত্র?

এ থেকেই বিজ্ঞানীরা এই পূর্ণ চৈতন্যময়তার ধ্বংস করেছেন, স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণের এখন একটি চেষ্টা শুরু হয়েছে। যে পদ্ধতিতে এটা করা হয়ে থাকে—তার নাম মানুষমুখী নীতি (anthropic principle)।

এতে দেখানো হয় যে, জগতের সৃষ্টির বিভিন্ন সময়ে বহু সম্ভাবনার মধ্যে একটা বিশেষ ও নির্দিষ্ট ঘটনা ঘটেছে। বারে বারে এভাবে বহু সম্ভাবনার মধ্যে নির্দিষ্ট একটা ঘটনা বাস্তবায়িত হয়েছে।

ফলে মানুষ পর্যন্ত এসেছে। যদি একবারও এর ব্যতিক্রম হত, তবে মানুষের উদ্ভব সম্ভব হত না। সত্যিই ত আল্লাহ্ যদি মুহাম্মদ (সা.)-কে সৃষ্টি না করতেন তাহলে তিনি সৃষ্টিই করতেন না।

অধিকন্তু আল্লাহ্ ছিলেন নির্ব্যক্ত, তিনি ব্যক্ত (প্রকাশ) হতে চাইলেন, তাই ত প্রকাশ করলেন নিজকে, সৃষ্টি হল বিশ্বজগত, সর্বশেষে মানুষ অর্থাৎ প্রথম থেকেই সৃষ্টির উদ্দেশ্য ছিল মানুষমুখী, ক্রিয়ার

উদ্দেশ্য থাকে কর্তার মনে, কাজেই এই উদ্দেশ্যটা আল্লাহরই ছিল (See, The cosmology of life and mind: Synthesis of science and religion by George Wald, 1988, Novel Lauret of 1967 )।

সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ

কিন্তু হিন্দু দর্শনের লীলাবাদের এটা সম্পূর্ণ বিপরীত

উল্টো বুঝলি রাম’ । এখানে সৃষ্টিটা যেহেতু স্রষ্টার লীলা, কাজেই এতে উদ্দেশ্যে নিহিত নেই। ফলে হিন্দু দর্শন নির্ণয়বাদী নয়, যদৃচ্ছাবাদী (Randomistic) আমরা মুসলমানেরা উদ্দেশ্যবাদী বিশ্বাসী— কুরআন আমাদের এটা শিখিয়েছে।

ধর্মগ্রন্থগুলো (কুরআন সমেত) বলে, বিশ্ব সৃষ্টি হয়েছিল এবং আল্লাহ্ পাক সেটা করেছিলেন। কিন্তু বস্তুবাদীরা (মার্কস-লেনিনবাদী কমিউনিস্টরাসহ) বলতেন, বস্তুর রূপান্তর ঘটে, ধ্বংস নয়। বস্তু অনাদি ও অনন্ত। অতএব জগতের সৃষ্টি বা ধ্বংসের প্রশ্ন নেই। এই প্রশ্নের বৈজ্ঞানিক সমাধান দিতে এল তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র।

এই সূত্র অনুযায়ী কাজ করলে শক্তি ক্ষয় হয় । শক্তি ধ্বংস হয় না, কিছুটা শক্তি অপ্রাপ্য হয়ে যায় (এন্ট্রাপি)। যত কাজ হয়, এন্ট্রাপি তত বাড়ে। এভাবে এমন একটা সময় আসবে যখন পুরো শক্তিটাই অপ্রাপ্য হয়ে যাবে, তখন কাজও হবে না । ফলে জগতের তাপমৃত্যু ঘটাবে।

কারণ রূপ ধারণ করার জন্যও শক্তি দরকার । সেক্ষেত্রে একদিন প্রাপ্য শক্তির পরিমাণ সর্বাধিক ছিল অর্থাৎ জগতের সৃষ্টি হয়েছিল। জগত সসীম হলে তার জন্ম মৃত্যু আছে। এই সূত্র মার্কসীয় ও অন্যান্য বস্তুবাদীর প্রচুর গাত্রদাহের কারণ হয়েছে। মার্কসীয় দর্শন অনুযায়ী জগত অসীম, বস্তু ও গতি সদানিত্য । জগতের ধ্বংস নেই, শুধু প্রসারণ ও সংকোচন হয়।

এইসব দার্শনিক তর্কের মধ্যে বৈজ্ঞানিকেরা স্থির করলেন, ব্যাপারটি পরীক্ষা করে দেখতে হবে । বস্তু যে নৈর্ব্যক্তিক বাস্তব নয়, সেটা দেখাল কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা ।

স্থানকাল যে সসীম, তা দেখাল আপেক্ষিকতাবাদ (সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ)

জগতের সৃষ্টির প্রমাণ যোগাল জ্যোতিঃপদার্থ বিদ্যা। ১৯২৯ সালে এডউইন হাবল আবিষ্কার করলেন জগত প্রসারণশীল । এই প্রসারণ মহাকর্ষের বিরোধী, সুতরাং এটা এল কোত্থেকে?

মহাজাগতিক ডিম ফেটে জগত সৃষ্টি হয়—এই তত্ত্ব হাবলের আবিষ্কারের ব্যাখ্যা দিতে পারল । সৃষ্টির প্রথমাবস্থায় অতি ভয়ঙ্কর তাপের সৃষ্টি হয়েছিল । বস্তু ছিল না, ছিল ছিল শুধু বিকিরণ আর নৃত্যরত কণার দল।

পরে জগত আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা হয়েছে। কিন্তু সেই প্রাথমিক বিকিরণ কি হারিয়ে গেছে? না, হারায়নি, তা ১৯৬৫ সালে পেনিজিয়াস ও উইলসন ধরতে সক্ষম হয়েছেন।

প্রমাণিত হল জগত সসীম এবং তার জন্মমৃত্যু আছে। ১৯৯২ সালে মহাশূন্যে হাবল টেলিস্কোপ খুঁজে পেল ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়শান। তাপমাত্রা কোটি কোটি ডিগ্রী সেলসিয়াস থেকে ঠাণ্ডা হতে হতে বর্তমানে মাত্র ৩ ডিগ্রী কেলভিন (অর্থাৎ শূন্যের নিচে মাইনাস ২৭৩ ডিগ্রী কেলভিন হলে বিশ্বজগত তাপের অভাবে পরম শূন্য ডিগ্রীতে জমে গিয়ে মরে যাবে)!

সে জায়গায় মাইনাস ২৭০ ডিগ্রী হয়ে গেছে, বাকী আছে মাত্র ৩ ডিগ্রী। সৌরজগতের বাইরে আন্তঃনাক্ষত্রিক মণ্ডলে অন্ধকার স্থানে এই হিম শীতল অবস্থা চলছে। প্লেনে করে ৫ মাইল ওপরে উঠলেই দেখা যায় মাইনাস ৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াস শীত।

দেখা গেছে জগতের প্রসারণ বেগ মহাকর্ষের টানে ক্রমশ কমছে। কমতে কমতে প্রসারণ একদিন থেমে যাবে।’ তারপর শুরু হবে মহাসঙ্কোচন।

সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ

ব্যক্ত জগত অব্যক্তে পরিণত হবে

সংকোচন শেষ হবে শূন্যতে। অঙ্কশাস্ত্র তাই বলে । এত সাধের জগত এভাবে শূন্যে মিলিয়ে যাবে, এটি মানতে বিজ্ঞানীরা প্রস্তুত নন। তাই তাঁরা শূন্যের বদলে একটা নতুন শব্দ সৃষ্টি করেছেন— সিংগুলারিটি অর্থাৎ বহুবচন একবচন হবে।

তাঁদের বক্তব্য এক বচন থেকে ঘুরে জগত আবার বহুবচনের দিকে এগোবে। এভাবেই বহু- এক-বহু, প্রসারণ-সঙ্কোচন-প্রসারণের চক্র চলতে থাকবে। এ চক্র অনাদি, অনন্ত । এই আজগুবি এক বচনকে মানলে ব্যক্ত জগত অব্যক্তে যায় না। প্রাপ্য শক্তি আবার সর্বোচ্চ না হলে পরবর্তী বিগ ব্যাংগটা হবে কি করে?

১৯৯৪ সনে ফ্রাঙ্ক টিপলার সপ্রমাণিত করতে চেয়েছেন যে, সেই অতীতকাল থেকে ধর্ম নামে অস্তিত্বমান এক কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাকহোলের দিকেই বিজ্ঞান ধাবিত হয়ে চলছে।

এই উক্তি তিনি করেছেন ‘দি ফিজিক্স অব ইমমর্টালিটিঃ মর্ডান কসমোলজি, গড এন্ড দি – রিসারেকশান অব দ্যা ডেড” (অবিনশ্বরতার পদার্থ বিজ্ঞান : আধুনিক সৃষ্টিতত্ত্ব, আল্লাহ্ ও মৃতের পুরুত্থান) গ্রন্থে।

টিপলার দাবি করেছেন সময়ের চূড়ান্ত বিভাজনে আমাদের এমন তথ্য ও কম্পিউটার শক্তি করায়ত্ত হতে পারে যার সাহায্যে মৃত সকল মানুষের পুনরুত্থান ঘটানো সম্ভব ৷ তিনি বলেছেন, “ওমেগা পয়েন্টে” অর্থাৎ যেখানেই স্থান ও কাল শেষ হয়ে যায় সেই মুহূর্ত বা বিন্দুতে পৌঁছলে মৃত সকল মানুষই জেগে উঠবে।

আল্লাহ্ আছেন, আছে বেহেস্ত (সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ)

টিপলারের গণনা অনুযায়ী সেই পুনর্জন্ম ঘটবে অবশ্যই কম্পুটারে অর্থাৎ ভারচুয়াল রিয়ালিটিতে। আর মানুষ মৃত্যুর পরে বেহেশতের অনুরূপ রাজ্যে জীবন কাটাতে পারবে।

ইদানিং আরো কিছু পদার্থ বিজ্ঞানীরা বলেছেন, এক রোমহর্ষক সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন, এই জগতে যে সিংগুলারিটির সন্তান তার জন্ম হয়েছিল অন্য কোও বিশ্বে ।

সেখানে এক পারটিল অ্যাকসিলারেটরে দুই কণার সংঘর্ষে। সেই বিন্দু থেকে এই বিশ্ব!! বিজ্ঞানী কিটি ফার্গুশন অন্যভাবে দেখাতে চেয়েছেন যে, প্রকৃতির বিধি-নিয়ম বা সূত্রাবলীকে অগ্রাহ্য না করেও আল্লাহর পক্ষে এই বিশ্ব জগতে এমন কি ব্যক্তির জীবনেও হস্তক্ষেপ বা প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব এবং সেটা সম্ভব বিজ্ঞানসম্মতভাবেই।

পল ডেভিস যুক্তি দিয়ে এবং বিজ্ঞানসম্মভাবেই প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, আল্লাহ্ বা কোন না কোন রকমের এক সর্বশক্তিমান সত্তার অস্তিত্ব নিশ্চয়ই আছে। ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত তাঁর বই “গড় এণ্ড দি নিউ ফিজিক্স” দিয়েই বিজ্ঞানীদের এই আল্লাহ্ চর্চা শুরু।

তারপর ১৯৮৮ সনে স্টিফেন হকিং তাঁর ‘সময়ের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসে’ বলেনঃ আমরা যদি মহাবিশ্বের একটি পূর্ণাঙ্গ তত্ত্ব খুঁজে পাই তাহলে সেটা হবে মানুষের যুক্তি বা বিচারশক্তির চূড়ান্ত বিজয়।

কেননা তখনই আমরা আল্লাহ্র মনকে যথার্থ অর্থে জানতে পারব। ডেভিস ১৯৯২ সালে লেখেন ‘দি মাইন্ড অব গড’, লেডার ম্যান লিখলেন ‘দি গড পার্টিকেল’, ১৯৯৪ সনে ফার্গুসন লিখলেন, ‘দি ফায়ার ইন দ্যা ইকুয়েশানস : সায়েন্স, রিলিজিয়ন এন্ড দ্যা সার্চ অব গড ।’

পদার্থ বিজ্ঞানীরা এখন বলছেন স্বয়ম্ভূ বিশ্বের কথা যা কুরআনে বহুবার উল্লিখিত হয়েছে। লেডারম্যানের বইয়ের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘হিগস কণা’ যার সন্ধান এখনও মেলেনি।

সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ

অথচ পদার্থ বিজ্ঞানীদের মনে যার অস্তিত্ব সম্পর্কে তেমন দ্বিধা নেই

নানারকম কণার ভর কেন নানারকম হয়, তার রহস্য বিজ্ঞানীদের জানা নেই। একটা ইলেকট্রনের ভর কেন কোনও একটি কোয়ার্কের ভরের দশ হাজার ভাগের এক ভাগ, তার কোনও কারণ জানা নেই । অদ্যাবধি।

মনে হয় প্রকৃতি যেন একেকটা কণাকে একেক রকম ভর দিয়ে রেখেছে খেয়ালখুশি মত এই রহস্যময় ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করার জন্য বিজ্ঞানী পিটার হিগস দিয়েছেন ‘হিগস ফিল্ডের ধারণা ।

কোন কণা যেমন ইলেকট্রিক চার্জ পায় ইলেকট্রন ম্যাগনেটিক ফিল্ডের মধ্য দিয়ে চলার সময়, ঠিক তেমনি বিভিন্ন কণাও তাদের ভর লাভ করে হিগ্‌স ফিল্ড-এর মধ্য দিয়ে সাঁতার কাটার সময়। আর ওই হিগ্‌স ফিল্ড-এর সমুদ্রে উপস্থিত কণাই হল হিগ্‌স পারটিকল । তাই হিগ্‌স কণাই আপাতত ‘গড পারটিকল’। সত্যিই আল্লাহ্ সর্বত্র বিরাজমান ।

বৈজ্ঞানিকেরা মনে করেন, দেশকাল কতকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র একক দিয়ে তৈরি। দেশ কোন স্থান নয়, সময় কোন মুহূর্ত নয়, নৈর্ব্যক্তিক এককের সমষ্টিমাত্র। এরই মধ্যে রয়েছে কোয়ান্টাম চরিত্র। এমনও হতে পারে যে, বস্তুগ্রাহ্য বিশ্ব আমাদের সাধারণ ধারণার দেশকাল ছাড়িয়ে আরও বহুদূর বিস্তৃত।

এর সামান্যতম কিছু এককমাত্র একটা নিয়ন্ত্রকের অধীনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আছে। সমুদ্রসদৃশ আরও অসংখ্য একক রয়েছে অন্যত্র। তাহলে আমাদের সীমিত দেশকালের বাইরে সেই অনন্ত সমুদ্রে কি আত্মার যথার্থ বাসস্থান? কেননা আত্মার তো কোন আয়তন নেই !

কোয়ান্টাম কসমোলজীতে বৈজ্ঞানিকেরা দেখাবার চেষ্টা করেছেন যে, আমাদের বিশ্বের অনুরূপ বিশ্ব আছে। প্রতিটি বিশ্বই বাস্তবিকভাবে সত্য। তবে বিভিন্ন বিশ্বের অধিবাসীদের দর্শন ভিন্ন রকম হতে পারে। জগত যখন দু’ভাগে বিভক্ত হয়, মানুষের মনও সেই সঙ্গে বিভক্ত হয়ে যায়।

যাঁরা বলেন যে, বিভক্ত হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি তাঁরা অনুভব করতে পারেন না, তাঁদের মনে রাখতে হবে যে, তাঁরা পৃথিবী যে সূর্যের চারদিকে ঘুরছে ওটাও বুঝতে পারেন না।

সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ

এই পৃথকীকরণ হামেশাই ঘটে চলেছে (সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ)

প্রতিটি অনু পরমাণুর নৃত্যছন্দে এই পৃথকীকরণ ঘটে যাচ্ছে। প্রতি সেকেণ্ডে অসংখ্যবার বিশ্বজগতের প্রতিলিপিকরণ ঘটছে।

এটা ধরার জন্য কোন পরিমাপ করার প্রয়োজন নেই । অতি ক্ষুদ্ৰ পরমাণুর সঙ্গে বৃহৎ বস্তুজগতের প্রতিনিয়ত প্রতিক্রিয়া ঘটছে। সত্যের স্বরূপই রয়েছে এই অনন্ত পৃথকীকরণের মধ্যে।

অন্যান্য যে বিশ্ব রয়েছে, তা দেখতে কি রকম? আমরা কি সেই সব বিশ্বে যেতে পারব? না, বিজ্ঞানীরা বলছেন, আমাদের দেশকালের পথ ধরে সেখানে যাওয়া সম্ভব নয় ।

বিভক্ত বিশ্ব যত দূরে সরে যাচ্ছে ততই আমাদের সাথে ব্যবধান বেড়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন বিশ্বে জীবের অস্তিত্বও বিভিন্ন প্রকার। এসব বিষয়ে স্পষ্টভাবে বোঝার জন্য সময়ের রহস্যের মধ্যে ডুব দিতে হবে।

একদিকে থেকে দেখতে গেলে আমরা সবাই সময়ের পিঠে চেপে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছি। কিন্তু এই ভবিষ্যতে কেউ আমাদের অনেক আগেই গিয়ে পৌঁছুতে পারে। এই পারার কারণ সময়ের সংকোচন-বিকোচনশীলতা।

যেমন একই বয়সের দুই ব্যক্তির মধ্যে দেখা গেল ভবিষ্যত বার্ধক্য কারো ক্ষেত্রে আসছে আগে, কারো পরে। সময়ের গতিতে লাগাম পরিয়ে কেউ তাকে অনেকটা কম গতিসম্পন্নকরে তুলতে পারে।

আবার কেউ হয়তো কয়েক ঘন্টার মধ্যে দু’হাজার বছর স্পর্শ করতে পারে। আলোর গতির কাছাকাছি এলেই সময়ের বুনন ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য কেউ যদি সময়ের গতিও অতিক্রম করতে যায়—

সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ

তাহলে সময়ের অভ্যন্তরস্থ সবকিছু বাইরে চলে আসবে (সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ)

বিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞান আজ এসব কথা বলছে । এ যেন মহানবীর মি’রাজের তাৎপর্য—ব্যাখ্যা করার জন্যই কোয়ান্টাম তত্ত্ব ও আপেক্ষিক তত্ত্বের এই ব্যাখ্যার অবতারণ
পদার্থবিদদের মতে, বহির্বিশ্বের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত বলতে কিছু নেই।

কোন কিছুকেই পরিবর্তিত করা যায় না। ‘স্বাধীন ইচ্ছা’ শব্দটি একটি ধোঁকা মাত্র। ভবিষ্যত এখনি আছে এমন হতে পারে না। আণবিক স্তরে ঘটনাপ্রবাহ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ঘটে, এর জন্য কোন কারণের প্রয়োজন হয় না।

সময়ের প্রবাহে প্রতিটি বিন্দুতে ঘটনা ঘটে চলেছে। এর মধ্যে কতকগুলো ঘটনার পেছনে কারণ আছে। কারণ থাক বা না থাক সবই আছে।

সুতরাং যথার্থ অর্থে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত বলতে কিছু নেই। আধুনিক কসমোলজি-দেখিয়ে দিচ্ছে যে, আমাদের বিশ্ব নিত্যদিন দেশের বুকে নতুন দিগন্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং এই দিগন্তের ওপর থেকে নিত্যদিন নানা প্রভাব এসে জগতের ওপর পড়ছে।

আমাদের মন এই বস্তুজগতের অন্তর্ভুক্ত নয় । তবে মনের ক্রিয়া এই স্থূল বস্তুজগতে ঢুকে পড়ে একে প্রভাবিত করতে পারে। এখন প্রশ্ন হল: মনকে কিছু একটি করতে, চিন্তা করতে নির্দেশ কে দেয়? মানুষের যদি স্বাধীন ইচ্ছা প্রয়োগের ক্ষমতা থাকে তাহলে স্রষ্টারই বা থাকবে না কেন?

স্রষ্টা যদি নিজের ইচ্চায় জগৎ সৃষ্টি করতে পারেন তাহলে তার সব ইচ্ছাই অবশ্য পূর্ণ হবে

তিনি মানুষকে তাঁর (স্রষ্টার) পরিকল্পনার বিরুদ্ধে কাজ করতে দিতে পারেন যদি অবশ্য তেমন ইচ্ছে তাঁর হয় । অণুপরমাণুকে তিনি কোয়ান্টাম সূত্রে বিশ্বজগতে আকস্মিকতার খেলা খেলবারও সুযোগ দিতে পানে।

সর্বশক্তিমানের ক্ষেত্রে স্বাধীনতার যে ধারণা, মানুষের ক্ষেত্রেই সেই ধারণা ভিন্নতর । মানুষ যা ইচ্ছা তাই করবার ক্ষমতা তার নেই। আসলে মানুষের ক্ষমতা সীমিত। সীমিত ক্ষেত্রেই শুধু সে তার স্বাধীন ইচ্ছা প্রয়োগ করতে পারে।

অপরপক্ষে সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র ক্ষমতা সীমাহীন। তিনি যা খুশী তাই করতে পারেন। মানুষ ভবিষ্যতকে জানতে পারে না । সুতরাং সমস্যা প্রায় দুরতিক্রম্য।

কোয়ান্টাম ফিজিক্স ও আপেক্ষিকত্ত্ব যত কিছুই চমকপ্রদ তত্ত্ব আমাদের জানিয়েছে (সবগুলোই কুরআনে আছে) তার চেয়ে বহু প্রশ্নের জনাব অনুত্তরই রেখেছে । হয়তো সময় সম্পর্কে আমাদের ভাবী জ্ঞান আমাদের অস্তিত্বের ওপর নতুন আলোকপাত করবে।

অনিশ্চয়তাবাদের উদ্ভাবক হাইজেনবার্গ বলেছেন যে, বস্তুসত্তাকে ভাঙতে ভাঙতে যত ক্ষুদ্র উপাদানই আমরা আবিষ্কার করি না কেন জগতের মৌল উপাদানের সাক্ষাৎ এখনও আমরা পাইনি; বরং বস্তুর এই সূক্ষাতিসূক্ষ্ম বিভাজন আমাদের কার্যে অর্থহীন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এককেন্দ্রিক একটি ধারণা এ ব্যাপারে অনেকটা সহজ উত্তরের ইঙ্গিত দিয়েছে।

সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ

বিশ্বজগত শৃঙ্খলাবদ্ধ-কঠোর নিয়মকানুন গাণিতিক সূত্রে আবদ্ধ

গ্যালাক্সি থেকে শুরু করে অণু-পরমাণুর অভ্যন্তরভাগ পর্যন্ত এই নিয়মানুবর্তিতা বিদ্যমান। সৌর জগতে অদ্ভূত ছন্দ বর্তমান ।

জীবকোষের মধ্যেও ছন্দের অভাব নেই । বৃহৎ জগতে রয়েছে একটি সার্বিক ছন্দ। সূক্ষ্ম জগতে সূক্ষ্ম ছন্দ। সূক্ষ্ম জীব-সত্তার মধ্য দিয়ে যেন একটা বিচিত্র ছন্দ নেচে নেচে চলেছে বিশেষ একটি উদ্দেশ্যের দিকে। সমস্ত বিশ্বপ্রকৃতিকে যেন একটা অদ্ভূত ছন্দ ধরে রেখেছেন।

সূক্ষ্ম আণবিক জগতেও এই সুর-ছন্দের অভাব নেই। কী এক প্রচণ্ড আনবিক শক্তি অণুগুলোকে ধরে রাখছে। নিউট্রন ও প্রোটনকে এই প্রচণ্ড নিউক্লিয়ার ফোর্স বেধে রেখেছে। এই প্রচণ্ড শক্তির জন্যই নিউক্লিয়াস (কেন্দ্র) ভাঙতে হলে প্রচুর তেজের দরকার হয় (পরমাণু কণা)।

এ কথা সব সময়েই স্বীকৃতি পেয়েছে যে, প্রকৃতির গঠনশৈলীতে সিমেট্রির (সংমিতি) একটা বিষয় মূল্যবান ভূমিকা রয়েছে। সাব-নিউক্লিয়ার বা সাব-আণবিক জগতের চরিত্র অনুসন্ধানকালে বৈজ্ঞানিকদের মনে এই ধারণাই জন্ম নিয়েছে যে, প্রাকৃতিক সর্বপ্রকার জটিলতার অন্তরালে কোথাও একটি সহজ ভাব আছে ৷

বিজ্ঞানের সামনে এখন এক নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে তা হল শক্তি ও সময়ের। এই দুটি ধারণাকে একত্রে যুক্ত করার চেষ্টা হলে এই ধরনের বক্তব্যের মধ্যে আমাদের পড়তে হবে—Know one and you unknow the other?

বৃহৎ জগতে আমরা শক্তির বিভিন্ন রূপ (স্থিরীকৃত) দেখি। কিন্তু কোয়ান্টাম জগতে ক্ষুদ্র বিশ্বে শক্তিশূন্যতা থেকে যেন অকস্মাৎ আবির্ভুত হয়ে আবার তেমন করেই মিলিয়ে যায়।

সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ

এর কার্যকারণ পদ্ধতি স্বতঃস্ফূর্ততা

বিজ্ঞানীদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এখন সত্যিই দেখা যাচ্ছে বস্তুসত্তাসম্পন্ন পার্টিকেল বাইরের কোন প্রভাব ছাড়াই সৃষ্টি হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে ক্ষুদ্র বিশ্বে হঠাৎ শক্তির আবেগ উড়ন্ত ইলেকট্রন পজিট্রন যুগলের সৃষ্টি করছে অল্পক্ষণের জন্য।

এই সব ভৌতিক আবির্ভাবের সার্বিক সম্মেলন দেশ (Space)-কে একটি গতিশীল ধূম্রাকার অবাস্তবিক অস্তিত্ব দান করছে। এই নিঃশেষ কার্য প্রবাহের মধ্য দিয়েই অণু-পরমাণুগুলি যেন সাঁতরে বেড়ায় { Higgs Field) !

একটি ইলেকট্রন এ সব ভৌতিক অনুষঙ্গী ছাড়া একা থাকতে পারে না, (আল্লাহ্ জোড়ায় জোড়ায় সব কিছু সৃষ্টি করেছেন)। এই জোড় বাঁধার শক্তি বা ইলেকট্রনের ভেতরের হার্ট স্পিনের পরস্পর বিপরীতমুখী চলাতেই (এদের সার্বিক অবস্থাই) এদের গতি সঞ্চার করে।

এ থেকে এই ধারণাই স্পষ্ট হয় যে, বস্তুগ্রাহ্য প্রকৃতির কোয়ান্টাম অবস্থায় একটা সার্বিক ভাব (holistic flavour = God) আছে। প্রতিটি জিনিসই অপরের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে, অথচ ঐক্যের মধ্যে ক্রমধারার একটা সাংগঠনিক অবস্থাও বিরাজ করছে।

এই সার্বিক অবস্থার মধ্য থেকেই পদার্থবিদরা বস্তুর মৌল উপাদান খুঁজবার চেষ্টা করছেন। এই সর্ব সত্তার একক উৎস জানার জন্য নিজেদের ব্যস্ত রেখেছেন।

সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ

উৎসে বস্তু বলে কিছু নেই—আছে শক্তি (সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ)

বস্তুত বিজ্ঞানীরা বস্তুর উৎস সন্ধান করতে গিয়ে যা পেয়েছেন তা এই যে, উৎসে বস্তু বলে কিছু নেই—আছে শক্তি। মহাশূন্যের বুকে শক্তির নৃত্য থেকেই পার্টিকলরূপে বস্তুর উপাদান ফুটে উঠে ডুবে যাচ্ছে। অনন্ত এই লীল’র মধ্যে থেকেই অণু-পরমাণুর পারস্পরিক সংযোগে একটি ধোঁয়াটে ধরনের সার্বিকতা তৈরি হচ্ছে এবং তার মধ্য থেকে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সাহায্যে অণু-পরমাণু বস্তুসত্তা সৃষ্টি করছে, যা নাকি তুলনামূলকভাবে স্থায়ী বিশ্বের রূপ নিচ্ছে !

এই যে, বিশ্বসৃষ্টি, এখন প্রশ্ন, এর পেছনে কোন সুপরিকল্পনাসম্পন্ন চিৎশক্তি কাজ করছে, না অকস্মাৎই জগত ফুটে উঠছে? বৃহৎ বিশ্বে নিয়মের শৃঙ্খলা দেখে ধারণা হয় সৃষ্টির পেছনে কোন চিৎসত্তা অবশ্যই আছে যাকে বলা যেতে পারে আল্লাহ্ ।

অপর পক্ষে অণু-পরমাণুসমূহের পারস্পরিক সংযোগ, নির্বাচন, প্রত্যাখ্যান প্রভৃতিই যে সৃষ্টির আদিতে কাজ করেছে এবং এখনও করছে, অনেকে সে রকমও মনে করেন ।

ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অণু-পরমাণুর পারস্পরিক সংযোগ একটা অঙ্গ-শক্তির ঠেলাতেই অকস্মাৎ সৃষ্টির উপাদান তৈরি করেছে (জৈব ও অজৈব বৃহত্তর দেহ)। তারপর তাপগতির স্বাভাবিক প্রবণতা থেকে জগৎ একটা ছন্দময় শৃঙ্খলায় চলে এসেছে। প্রাকৃতিক শৃঙ্খলাও দেশের বুকে মহাশক্তির স্বাভাবিক পরিণতি ।

এর পেছনে অনেকে স্রষ্টার উপস্থিতি দেখেন না, যেহেতু অনুসন্ধানে ধরা পড়েছে যে, জগতে অধিকাংশ সমইে বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে কেটে যায়; সেখানে কোন সাংগঠনিক শৃঙ্খলার বালাই-ই নেই। তবে মাঝে মধ্যে কোটি কোটি বছরের জন্য সেখানে আকস্মিক শৃঙ্খলা দেখা দেয় । সৃষ্টি এখানে একটি রূপায়িত ভঙ্গিতে একবার ফুটে উঠে নিবে যায় । এখানে জীবন বিশেষ একটি বাস্তব অবস্তার সুযোগেই আত্মপ্রকাশ করে ।

সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ

চৈতন্যের উদ্ভবও একটি বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই

মহাবিশ্বের ধূম্রাকৃতি অণু- পরমাণুসমূহ যেভাবেই হোক কোথাও এমন মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে পড়ে যায় যে, বস্তুকণাসমূহ সেই প্রবল আকর্ষণে কোথায় যে হারিয়ে যায় তার আর হদিস পাওয়া যায় না । সেই স্থান জুড়ে থাকে একটি কৃষ্ণগহ্বর ।

এ সব দেখে কোন কোন বিজ্ঞানী মনে করছেন বিশ্বের কোন স্রষ্টা নেই। এখানে একটি স্বভাবের খেলাই মাত্র বিদ্যমান। স্বভাবে সৃষ্টি, স্বভাবেই লয়। এমন ধরনের মতবাদী বিজ্ঞানীদের সংখ্যা ক্রমশই কমে আসছে। মার্কসীয় দর্শনের পতন হয়েছে। বস্তুবাদীদের চিন্তাধারায় ফাটল ধরেছে। আরো কিছু পরীক্ষার প্রমাণ পাওয়া গেলে এইসব নাস্তিক্যবাদীরা হারিয়ে যাবে।

বিজ্ঞানের আলোচনা এজন্য সম্ভব হয়েছে, কারণ আপাতদৃষ্টিতে যে বিশ্বজগতে আমরা বাস করি তা একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ জগত । অঙ্কের সহজ গতি অনুসারে এটা চলছে । বিজ্ঞানের কাজ হল এ বিষয়ে চর্চা করে এই শৃঙ্খলার চরিত্র আবিষ্কার করা—কিভাবে কি হয়েছে সে প্রশ্ন করা নয়।

তর্ক দ্বারা এটা প্রমাণ করা দুঃসাধ্য যে, আল্লাহ্ একই সঙ্গে সর্বশক্তিমান ও ব্যক্তিত্ব নিয়ে অবস্থান করছেন। তাই ধর্মগ্রন্থে, বিশেষ করে হাদীসে নিষেধ করে দেয়া আছে যে, সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করবে না, কেননা এটি মানব মস্তিষ্কের বোঝার বাইরের ব্যাপার।

মানুষ কেবল আল্লাহর সিফাত বা প্রকাশজাতের স্বরূপ অনুসন্ধান করতে পারে। বেদান্তদর্শন অনুযায়ী পরমজ্ঞান প্রসারণশীল, যত জানার চেষ্টা করা যায়, ততই তা বেড়ে যায় । এজন্য এর নাম হিন্দু শাস্ত্রে ব্রহ্মা-যা বর্ধিত হয় । আর এর প্রতিশব্দ হল বিশ্ব, জগৎ, সংসার। বিশ্ব অর্থাৎ সব।

সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ

সবকিছুই যার অন্তর্ভুক্ত তাই বিশ্ব (সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ)

কার্ল সাগানের ভাষায় “The cosmos is all that is as even was or even will be” অর্থাৎ যা চলমান, সম্পর্ণ জগৎ এবং তার অন্তর্ভুক্ত সবকিছুই সব সময় গতিশীল ! ধর্মতত্ত্ববিদেরা জাগতিক শৃঙ্খলা দেখে বলতে চান যে, এটাই আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণ করে। এরকম হলে ধর্ম ও বিজ্ঞান উভয়েরই চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় ঈশ্বরের (God) কার্যের স্বরূপ উদ্ঘাটন করা ।

আরো অনেক বছর কেটে যাবে, বিশ্বজগতের রহস্য বুঝতে। সেদিনই অমুসলিম জগত মি’রাজের সত্যতা বুঝতে পারবে। বিজ্ঞান যে ঐ দিকেই মুখ নিয়েছে এতক্ষণ এ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচিত হল ।

উল্লিখিত বিজ্ঞানীদের ডজন খানেক বই পড়লেই এটি বোঝা যাবে। বাংলায় জাহান মিয়া, মেজর কামাল ও আশরাফুল কাদেরের তিনটি বই রয়েছে কুরআন ও হাদীসের আলোকে বিশ্ব সৃষ্টির রহস্য মি’রাজ ও বিজ্ঞান সম্পর্কিত আলোচনার । এই প্রচেষ্টাগুলো আশাব্যঞ্জক। অন্ধভাবে বিশ্বাস না করে গবেষণার মাধ্যমে স্রষ্টা ও তাঁর সৃষ্টির স্বরূপ বোঝবার জন্য তাগিদ রয়েছে ।

বর্তমান প্রবন্ধকার বিশ্বাস করেন যে, কোন একটি অতি দ্রুতঃতিসম্পন্ন মহাকাশযানে করে মহানবী (সা.)-এর মি’রাজ সংগঠিত হয়েছিল। এই বিশ্বাসের পেছনে কারণ হচ্ছে তিনি এমনটিই একবার স্বপ্নে দেখেছিলেন ।

দীর্ঘ একুশ বছর আগে আরেকটি স্বপ্নের পর এই প্রশ্নটির সত্যতা নিয়ে সন্দেহ ছিল

মহানবীকে দেখা স্বপ্ন যদি সত্যই হয়ে থাকে তাহলে নিবন্ধকার আমৃত্যু এই বিশ্বাস নিয়ে থাকবেন। মি’রাজে মহানবী (সা.) স্রষ্টার ও সৃষ্টির নিগূঢ় সত্য পরিচয় পেয়েছিলেন। আমাদের প্রত্যেকের মি’রাজ তার নিজের সঙ্গেই রয়েছে । দরকার শুধু ধ্যান ও সাধনার ।

বাকী রয়েছে আপেক্ষিকতা ও কোয়ান্টাম সূত্রের বাইরে এমন এক “সব কিছুর সূত্র” যাতে প্রমাণ হবে God does not play dice. সব কিছু সুশৃঙ্খলভাবেই চলছে স্রষ্টার হুকুমে । এখানে Chaos ও একটি শৃঙ্খল (Chain) মাত্র ।

প্রিয় পাঠক, GulfHive এর সময় ও মহাকালের রহস্য এবং মহানবীর মিরাজ শুধুমাত্র আপনাদের সময়ের বিচিত্র কাহিনী ও মহাকালের অজানা রহস্য তথ্য দেওয়ার জন্য প্রকাশিত হয়েছে। এই পোস্ট এর বিষয়ে আপনার কোনো অভিযোগ বা পরামর্শ থাকলে নিচের বাটনে ক্লিক করে কমেন্ট করুন অথবা আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন। আপনি চাইলে ফেসবুকে আমাদের সাথে কানেক্ট থাকতে পারেন।

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *